শতকোটি টাকা ব্যয়েও প্রাণ ফেরেনি নরসুন্দার

প্রমত্তা নরসুন্দা নদী যেন এখন ময়লার ভাগাড়। শনিবার কিশোরগঞ্জ শহরের বড়বাজার এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

আজ ১৪ মার্চ আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস। নদী রক্ষায় করণীয় নিয়ে সরব হবেন বিশ্ববাসী। কিশোরগঞ্জেও দিবসটি উপলক্ষে আজ রোববার রাস্তায় থাকবেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কর্মীরা। জেলা শহরের সৈয়দ নজরুল ইসলাম চত্বরে যখন তাঁরা মানববন্ধন করবেন, তখনো প্রাণ যায় যায় অবস্থা থাকবে নরসুন্দা নদীর।

কিশোরগঞ্জ শহরের বুক চিরে বয়ে গেছে নরসুন্দা নদী। নদীটির নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে ২০১২ সালে পুনঃখনন ও পুনর্বাসনের বড় প্রকল্প নেওয়া হয়। তবে শতকোটি টাকা ব্যয়ের পরও নদীটির করুণ অবস্থায় তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরং শহরের অংশে নরসুন্দা এখন ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।

সরেজমিনে নরসুন্দা নদীপাড়ে গিয়ে দেখা যায়, শহরের বড় বাজারসহ কয়েকটি বাজারের সব ময়লা-আবর্জনা ও জবাই করা পশুর বর্জ্য ফেলা হচ্ছে নদীতে। এর দুর্গন্ধে দুর্বিষহ জীবন পার করতে হচ্ছে মানুষকে। নদীপাড় দিয়ে চলতে হলে নাক চেপে ধরে চলাচল করতে হয়। দুর্বিষহ দুর্গন্ধে পেট ফুলে যাওয়ার মতো অবস্থা। তা ছাড়া বাজারের সব ধরনের ময়লার পলিথিন, পচা কাঁচামালসহ জবাই করা পশুর বর্জ্য নদীতে গিয়ে অনেক জায়গায় ভাগাড়ে পরিণত হয়ে পড়েছে। সে ভাগাড়ে কাক-কুকুর ও গরু-ছাগল বিচরণ করছে।

শহরের বড় বাজার, গৌরাঙ্গ বাজারসহ নদীর দূষণ রক্ষায় নদীর পাড়ে কয়েকটি সাইনবোর্ড রয়েছে। তাতে কয়েকটি নির্দেশনা লেখা। এর মধ্যে রয়েছে, ‘নরসুন্দা নদীতে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন’ ‘আপনার এবং আপনার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুস্থ ও সুন্দর জীবনযাপনের স্বার্থে নরসুন্দাকে বাঁচিয়ে রাখুন’, ‘আপনার শহর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখুন, নদীতে জবাইখানার বর্জ্য ফেলা থেকে বিরত থাকুন’ ইত্যাদি। অথচ এসব সাইনবোর্ডের ঠিক নিচেই ময়লা ফেলে নদীটিকে ভাগাড়ে পরিণত করা হয়েছে। তা ছাড়া কিশোরগঞ্জের নরসুন্দা নদী খনন করে হ্রদে পরিণত করা হয়েছে। কোনো কোনো জায়গায় খননের আগের সময়ের চেয়ে এখনকার অবস্থা আরও করুণ।

  • নরসুন্দা নদী রক্ষায় ২০১২ সালে নেওয়া হয় ১১০ কোটি টাকার ওই প্রকল্প।

  • এ প্রকল্পের আওতায় কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর থেকে নীলগঞ্জ পর্যন্ত ৩৫ কিলোমিটার পুনঃখনন ও পুনর্বাসন প্রকল্পের কাজ শুরু করা হয়।

    এলাকাবাসী বলছেন, এত ব্যয় করা হলেও নদী নাব্যতা ফিরে পায়নি। প্রকল্পের টাকার বেশির ভাগই লুটপাট করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি) ও কিশোরগঞ্জ পৌরসভা যৌথভাবে কাজটি করে। প্রকল্পের কাজ শেষ হয় ২০১৬ সালে।

    শুরু থেকে এ নিয়ে সচেতন মহলসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ব্যাপক লুটপাটের অভিযোগ তুলে কয়েক দফা মানববন্ধনসহ বিভিন্ন আন্দোলন কর্মসূচি পালন করে। এ প্রকল্পে লুটপাটের অভিযোগ ওঠার পর ২০১৬ সালের ১৭ আগস্ট তিনজন সচিব কিশোরগঞ্জে এসে গণশুনানি করেন। গণশুনানিতে কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের নেতারা ব্যাপক লুটপাটের অভিযোগ করেন।

নরসুন্দা ভরাট হয়ে এখন সরু খালে পরিণত হয়েছে।
ছবি: প্রথম আলো

এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. রইছ উদ্দিনের নেতৃত্বে একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটি একাধিকবার সরেজমিন এলাকা পরিদর্শন করলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

কিশোরগঞ্জ শহরের বাসিন্দা ও নদী সুরক্ষা আন্দোলনের কর্মী ফয়সাল আহমেদ বলেন, পুনঃখনন ও পুনর্বাসন প্রকল্পে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। প্রশাসনের উচিত নদী ভরাটের উৎসব, অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করাসহ নদীর কচুরিপানা সরিয়ে নদীতে স্বচ্ছ পানির প্রবাহ ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা। পাশাপাশি শহরের ময়লা–আবর্জনা অপসারণের জন্য যেসব বড় বড় নালার মুখ নদীর দিকে দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর মুখে ভালো করে নেট লাগিয়ে দেওয়া, যাতে পানির সঙ্গে কোনো প্লাস্টিকের বোতল, পলিথিনসহ অন্য কোনো ময়লা নদীতে এসে নদীটিকে দূষণ করতে না পারে।

কিশোরগঞ্জ এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী আমিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, নরসুন্দা নদীতে পানিপ্রবাহ সচল করতে সরকার নতুন করে পরিকল্পনা নিচ্ছে বলে তিনি জানতে পেরেছেন। যে দপ্তরের মাধ্যমেই এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হোক না কেন, তারা নদীটির প্রাণ ফেরাতে ভূমিকা রাখবে বলে তিনি আশাবাদী।