শতাধিক কৃষকের জমিতে পুকুর খননের উদ্যোগ যুবলীগ নেতার

বিলের জমিতে ধানের চারা রোপণ করছেন কৃষকেরা। এসব জমি দখল করে পুকুর খননচেষ্টার অভিযোগ উঠেছে। শুক্রবার রাজশাহীর পবা উপজেলার শুভিপাড়া বিলেপ্রথম আলো

রাজশাহীর পবা উপজেলার শুভিপাড়া বিলে কৃষক নুর মোহাম্মদ (৫০) কোদাল দিয়ে খেতের কাজ করছিলেন শীতের সকালে। দু-এক দিনের মধ্যেই সেখানে ধানের চারা রোপণ করবেন। বিলে তাঁর দেড় বিঘা জমি রয়েছে। কিন্তু মনে শান্তি নেই। চারা রোপণের পর জমিটির মালিকানা তাঁর থাকবে কি না, সে শঙ্কা তাঁর।

নুর মোহাম্মদের বাড়ি উপজেলার বড়গাছি ইউনিয়নের শুভিপাড়া গ্রামে। এই গ্রামের আরেক কৃষক সিদ্দিক মোল্লার (৫৫) ১০ কাঠা জমিতে ইরি ধানের চারা রোপণ করা হয় গত শুক্রবার। ভবিষ্যতে মালিকানা থাকা নিয়ে শঙ্কায় থাকলেও তিনি বলেন, ‘মরব, তবু জমি দেব না।’

কৃষকেরা যে শঙ্কার কথা বলছিলেন, তা স্পষ্ট হয় তাঁদের সঙ্গে আরও কথা বলার পর। তাঁদের অভিযোগ, উপজেলা যুবলীগের সহসভাপতি মাহাবুব-উর-রহমান গ্রামের শতাধিক কৃষকের প্রায় ১৫০ বিঘা জমি জোর করে দখল নিয়ে পুকুর করতে চান। এ জন্য তিনি হাইকোর্টের একটি রিট নিয়ে এসেছেন। কয়েকজন কৃষকের কাছে থেকে কৌশলে ইজারার জন্য স্বাক্ষরও নিয়েছেন। কিন্তু জলাবদ্ধতার আশঙ্কা আর তিন ফসলি জমি বাঁচাতে কৃষকেরা পুকুর খনন করতে দিতে চান না।

শুভিপাড়া বিলে গ্রামের ১৭ জন কৃষকের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা জানান, গত বছর থেকে মাহাবুব-উর-রহমান কৃষিজমিতে পুকুর খননের জন্য তোড়জোড় শুরু করেন। এ নিয়ে কৃষকসহ এলাকার কারও সঙ্গে বসেননি। কোনো ধরনের অর্থও লেনদেন করেননি। এরপর হাইকোর্টের একটি রিট নিজের পক্ষে এসেছে দাবি করে ৮ জানুয়ারি পুকুর খননের জন্য গ্রামে সাইনবোর্ড ও খননযন্ত্র নিয়ে আসেন। তখন কৃষক ও যুবলীগ নেতার মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়। এ নিয়ে পবা থানায় ওই যুবলীগ নেতা সাধারণ ডায়েরি করলে এলাকার পাঁচ কৃষক ১৭ জানুয়ারি জমি বাঁচাতে আদালতে মামলা করেন। সেই মামলার নোটিশ গত শুক্রবার পবা থানা, উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি), ওই যুবলীগ নেতাসহ তিন বিবাদীর কাছে গেছে।

ওই নোটিশে আদালত পুলিশকে যুবলীগ নেতা যাতে পুকুর খনন না করতে পারেন ও এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় থাকে, সে বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছেন। তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সহকারী কমিশনারকে (ভূমি)। আর পুকুর কেন খনন করা হবে, সে কারণ দর্শাতে আগামী মার্চে বিবাদীদের আদালতে হাজির হতে বলা হয়েছে।

এ বিষয়ে মাহাবুব-উর-রহমান বলেন, পুকুর খননের জন্য গত বছর ওই এলাকার ৪৫ কৃষকের সম্মতিপত্র নিয়েছেন। আট বছরের জন্য তিনি কৃষকদের জমি লিজ নিয়ে পুকুর খনন করতে চান। প্রতি বিঘার মূল্য দেবেন ৩০ হাজার টাকা। তবে এখনো কাউকে টাকা দেননি। যেহেতু বিষয়টি আদালতে গেছে, তাই তিনি এখন আইনিভাবে লড়বেন।

গত শুক্রবার সকালে শুভিপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, কৃষকেরা তাঁদের জমি ধানের চারা রোপণের জন্য তৈরি করছেন। কেউ ট্রাক্টর দিয়ে জমি চাষ করিয়ে নিচ্ছেন, কেউ গভীর নলকূপের পানি দিয়ে শুকনো জমি ভিজিয়ে নিচ্ছেন। বিলের এক পাশে দুটি বড় পুকুর আছে। বিলে আবার পুকুর খননচেষ্টার প্রসঙ্গ তুলে দু-একজনের সঙ্গে কথা বলতেই ধীরে ধীরে জড়ো হন ১৭ জন কৃষক।

তাঁরা বলেন, দুই বছর আগে দুটি পুকুর খনন করার কারণে বিলের পানি নদীতে নামতে বাধা পাচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। প্রধান ফসল পানের বরজের ব্যাপক ক্ষতিও হয়েছে। নতুন করে পুকুর খনন হলে পানি বের হওয়ার আর কোনো পথ থাকবে না।

আমি পরিকল্পিতভাবে পুকুর খনন করতে চাই। পুকুরের পাশ দিয়ে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থাও করা হবে। এতে জলাবদ্ধতা হবে না।
মাহাবুব-উর-রহমান, সহসভাপতি, পবা উপজেলা যুবলীগ, রাজশাহী

যুবলীগ নেতার কাছে যাঁরা ইজারা দেওয়ার স্বাক্ষর দিয়েছেন, তাঁদের একজন কৃষক সিদ্দিক মোল্লা। তিনি বলেন, তিনি পড়তে পারেন না। তাঁর কাছ থেকে যুবলীগ নেতা ‘কৌশলে’ স্বাক্ষর নিয়েছেন। স্বাক্ষর নেওয়ার সময় যুবলীগ নেতা তাঁকে বলেছিলেন, ‘বিলে পুকুর খননের জন্য সবার সই (স্বাক্ষর) হয়ে গেছে। খালি তোমার সইয়ের জন্য আমার কাগজ যাচ্ছে না।’

আরেক কৃষক স্বপন আহমেদ বলেন, দুটি পুকুরের জলাবদ্ধতার কারণে তাঁর পানের বরজে পানি উঠে তিন লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। আরও পুকুর হলে গ্রামের সব পান বরজের ক্ষতি হবে।

এ বিষয়ে যুবলীগ নেতা মাহাবুব-উর-রহমান বলেন, আমি পরিকল্পিতভাবে পুকুর খনন করতে চাই। পুকুরের পাশ দিয়ে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থাও করা হবে। এতে জলাবদ্ধতা হবে না।