‘...শয্যা পেয়েছি কিন্তু মাকে বাঁচানো গেল না’

করোনা আক্রান্ত মা মাজেদা বেগমের মৃত্যুর পর মেয়ের কান্না। আজ শনিবার দুপুরে বরিশালের শের–ই–বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিট ভবনে।
ছবি: সাইয়ান

বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার মাজেদা বেগম (৭৫)। ১৩ জুলাই থেকে বরিশাল সদর জেনারেল হাসপাতালের করোনা ইউনিটে ভর্তি ছিলেন। অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমতে থাকায় শনিবার সকালে শের–ই–বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সুবিধাসংবলিত শয্যায় নেওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা। দুপুর পর্যন্ত চেষ্টা করে একটি শয্যা মিলেছিল। কিন্তু এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে যাওয়ার পথেই মারা যান মাজেদা বেগম।

শনিবার দুপুরে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটের নিচতলার বারান্দায় মাজেদার ছেলে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলছিলেন, ‘সকাল থেকে একটি শয্যার জন্য কত চেষ্টা, কত পরিশ্রম করেছি। শয্যা পেয়েছি কিন্তু আমার মাকে বাঁচানো গেল না।’ পাশে বুক চাপড়ে আহাজারি করছিলেন তাঁর বোন।

শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটিই বরিশাল বিভাগে সবচেয়ে বড় করোনা হাসপাতাল। ৩০০ শয্যার এই হাসপাতালের সব কটি শয্যাই ২০ দিন ধরে পরিপূর্ণ। নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রের (আইসিইউ) ২২টি শয্যা এক দিনের জন্যও ফাঁকা হয়নি। মুমূর্ষু অনেক রোগী আইসিইউর জন্য অপেক্ষমাণ। কোনো রোগী মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন রোগীকে শয্যা পেতে হচ্ছে আইসিইউতে।

মাজেদা বেগমের পরিবারের সদস্যরা জানান, বরিশাল সদর জেনারেল হাসপাতালের করোনা ইউনিটে শুক্রবার থেকেই মাজেদার অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমতে থাকে। শনিবার সকালে তা আরও কমে ৬০-এর নিচে নামে। সিলিন্ডারের অক্সিজেনের গতি (ফ্লো) তাঁর কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসে আর সহায়তা করতে পারছিল না। শেষমেশ চিকিৎসকেরা স্বজনদের দ্রুত শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সাপোর্ট দিতে বলেন।

মাজেদা বেগমের ছেলে আর এক স্বজন ছুটে গেলেন সেই হাসপাতালে। কিন্তু সেখানে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সুবিধা আছে এমন শয্যা খালি না থাকায় পাগলের মতো দৌড়ঝাঁপ করছিলেন। তাঁদের চোখেমুখে উদ্বেগ। তবু তাঁরা হাল ছাড়েননি। দুপুর ১২টার দিকে যেন তাঁদের একটু স্বস্তি এল, দুটি শয্যা খালি হয়েছে এমন খবরে। হন্তদন্ত হয়ে তাঁরা আবার ছুটলেন জেনারেল হাসপাতালে। মাজেদা বেগমকে অ্যাম্বুলেন্সে তুললেন, তখন তীব্র শ্বাসকষ্টে ছটফট করছিলেন তিনি। অ্যাম্বুলেন্স সাইরেন বাজিয়ে দ্রুত ছুটছে। ঘড়ির কাঁটায় তখন বেলা পৌনে একটা। অ্যাম্বুলেন্সটি এসে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটের নিচতলার গাড়ি বারান্দায় থামল। কিন্তু ততক্ষণে নিথর হয়ে গেছেন মাজেদা বেগম। মেয়ে, ছেলে আর স্বজনের কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে হাসপাতাল চত্বর।

শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্র জানায়, শনিবার সকাল আটটা পর্যন্ত এ হাপাতালের করোনা ওয়ার্ডে রোগী ছিল ৩০০। কোনো শয্যাই খালি ছিল না। এরপর দুপুর ১২টা পর্যন্ত আরও অন্তত ১০ জন রোগী এসেছে। শনিবার সকাল পর্যন্ত এখানে করোনা উপসর্গ নিয়ে ১০ জন এবং দুজন পজিটিভ রোগীসহ মারা গেছেন ১২ জন।

গত বছর এপ্রিলে বিভাগের করোনার প্রথম ঢেউ শুরু হওয়ার পর থেকে চলতি বছরের ২৪ জুলাই পর্যন্ত এই হাসপাতালের আইসোলেশনে উপসর্গ নিয়ে মারা যান ৭২০ জন রোগী। আর পজিটিভ রোগী মারা গেছেন ২৬৬ জন। এর মধ্যে চলতি জুলাইয়ের ২৪ দিনে এই হাসপাতালে উপসর্গ নিয়ে ১৮৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর পজিটিভ রোগী মারা গেছেন ৫৯ জন।

হাসপতালের সহকারী পরিচালক ও করোনা ইউনিটের ইনচার্জ মনিরুজ্জামান শাহীন প্রথম আলোকে বলেন, এখানে যেসব রোগী আসছেন, তাঁরা অবস্থা খারাপ হওয়ার পরেই আসছেন। তাঁদের সবারই বলতে গেলে অক্সিজেন স্যাচুরেশন অনেক নিচে থাকে। শেষ মুহূর্তে কিছু করার থাকে না।

তিনি বলেন, এখানে পর্যাপ্ত চিকিৎসক নেই। তিনজন চিকিৎসক এক পালায় ৩০০ রোগীর কীভাবে সেবা দিতে পারেন? এখনই শয্যা দিতে পারছেন না। ২২টি আইসিইউ এবং ১০টি হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা সব কটিতে রোগী। ১১৪টি সেন্ট্রাল অক্সিজেন শয্যার সাতটিতে সমস্যা আছে। এ ছাড়া এখানে শয্যা বাড়ানোরও কোনো সুযোগ নেই। সব মিলিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে।