শহীদ বুদ্ধিজীবী: অমলেন্দু দাক্ষীকে খাবার টেবিল থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়

পাবনা শহরের এই বাড়িতে ভাড়া থাকতেন চিকিৎসক অমলেন্দু দাক্ষী। গত রোববার শহরের পাথরতলা এলাকায়
প্রথম আলো

চিকিৎসক ছিলেন অমলেন্দু দাক্ষী। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ-ভাসানী) রাজনীতি করতেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি দল বাসার খাবার টেবিল থেকে তাঁকে তুলে নিয়ে যায়। তিন দিন নির্যাতনের পর তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

পাবনা শহরের পাথরতলা মহল্লায় অমলেন্দু দাক্ষী স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। স্বাধীনতার পর তাঁর স্ত্রী শোভারানী দাক্ষী সন্তানদের নিয়ে ভাড়া বাড়ি ছেড়ে চলে যান। বাড়িটি এখনো আছে। মুছে গেছে চিকিৎসক অমলেন্দুর সব স্মৃতি। তবে মহল্লাবাসী ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আজও অমলেন্দু দাক্ষী স্মরণীয় হয়ে আছেন।

অমলেন্দু দাক্ষীর পৈতৃক বাড়ি ছিল রাজশাহী শহরের মালোপাড়ায়। বাবা পার্বতীচরণ দাক্ষী ছিলেন দন্ত চিকিৎসক। বাবার মতোই তিনি দন্ত চিকিৎসা পেশা বেছে নেন। পাবনা শহরের ট্রাফিক মোড় এলাকায় একটি চেম্বার খুলে চিকিৎসা পেশা শুরু করেন। তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের সময় গ্রেপ্তার হন। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ৬ সেপ্টেম্বর আবার আটক হন। প্রায় এক বছর জেল খাটেন। ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শামসুজ্জোহাকে হত্যা করা হলে পাবনায় প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। অমলেন্দু দাক্ষী সেই মিছিলের উদ্যোক্তাদের একজন ছিলেন।

চিকিৎসক দাক্ষী মিশুক মানুষ ছিলেন। তাঁর স্ত্রীও মহল্লার বাসিন্দাদের সঙ্গে মিশে থাকতেন। স্বাধীনতার পর ভাড়া বাড়ি ছেড়ে তাঁরা চলে যান। যত দূর জেনেছি, ওই পরিবারের কেউ আর দেশে নেই।
ইয়াছিন আলী মৃধা, অমলেন্দু দাক্ষীর প্রতিবেশী

রশিদ হায়দার সম্পাদিত ‘স্মৃতি: ১৯৭১’ বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ডে শোভারানী দাক্ষী ‘আমার স্বামী’ রচনায় অমলেন্দু দাক্ষীকে তুলে নিয়ে যাওয়ার বর্ণনা দিয়েছেন। শোভারানী দাক্ষী লিখেছেন, ‘পোশাক বদলিয়ে লুঙ্গি পরলেন ডাক্তার (অমলেন্দু দাক্ষী)। খালি গায়েই খেতে বসলেন তিনি। রাত প্রায় নয়টা। আমি বসে আছি খাবার টেবিলেই। তাঁর সঙ্গে এই শেষ বসা। এ সময় বাইরে জিপের শব্দ। তারপর বুটের আওয়াজ। সচকিত হলেন ডাক্তার। বুটের শব্দ এগিয়ে এল। দরজায় অনবরত লাথির শব্দ। বুটের লাথি। আমি এগিয়ে গেলাম দরজা খুলতে। তার আগেই পূর্ব পাশের দরজা ভেঙে ফেলেছে পাকিস্তানি সেনারা। ঘরে ঢুকে পড়েছে চার-পাঁচজন।’

পাকিস্তান সেনাবাহিনী অমলেন্দু দাক্ষীকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে শহরের টেলিফোন ভবনে আটকে রাখে। তাঁর সঙ্গে আরও কয়েকজনকে সেখানে আটকে রাখা হয়। খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা টেলিফোন ভবনে আক্রমণ করেন। পাকিস্তানি সেনারা টেলিফোন ভবন ছেড়ে বন্দীদের নিয়ে তৎকালীন ইপসিক (বর্তমানে বিসিক) শিল্পনগরে চলে যায়। সেখানে ২৯ মার্চ অমলেন্দু দাক্ষীসহ কয়েকজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

স্বাধীনতার পর অমলেন্দু দাক্ষীর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধা বেবী ইসলামের সঙ্গে। পাবনা ডায়াবেটিস সমিতির সভাপতি বেবী ইসলাম বলেন, ‘অমলেন্দু দাক্ষীর আত্মত্যাগের স্মৃতি এখনো মনে পড়ে। স্বাধীনতার পর বেশ কয়েকবার তাঁর পরিবারের সঙ্গে দেখা হয়েছে। এরপর থেকে আর যোগাযোগ নেই। তাঁরা কোথায় আছে, তা–ও জানি না।’

পাবনা শহরে অমলেন্দু দাক্ষীর প্রতিবেশী ছিলেন ইয়াছিন আলী মৃধা। তিনি বলেন, ‘চিকিৎসক দাক্ষী মিশুক মানুষ ছিলেন। তাঁর স্ত্রীও মহল্লার বাসিন্দাদের সঙ্গে মিশে থাকতেন। স্বাধীনতার পর ভাড়া বাড়ি ছেড়ে তাঁরা চলে যান। যত দূর জেনেছি, ওই পরিবারের কেউ আর দেশে নেই।’

মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল পাবনা জেলা ইউনিটের সাবেক কমান্ডার হাবিবুর রহমান বলেন, মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই চিকিৎসক অমলেন্দু দাক্ষীকে হত্যা করা হয়েছিল। শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকায় তাঁর নাম আছে।