শিকলবন্দী থাকতে থাকতে অবশ হয়ে গেছে পা

১০ বছর ধরে এভাবেই শিকলে বেঁধে রাখা হয় শুকুম আলীকে। গতকাল বুধবার নড়িয়ার জালিয়াহাটি গ্রামে।
প্রথম আলো

ভোরের সূর্য ওঠার পর শুকুম আলীকে ঘর থেকে বের করেন পরিবারের সদস্যরা। এরপর তাঁকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয় বাড়ির সামনের একটি ছাপরা ঘরে। সারা দিন সেখানে কাটানোর পর ন্ধ্যায় আবার তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় ঘরে। এভাবেই কেটে গেছে ১০ বছর। শিকলবন্দী অবস্থায় থাকতে থাকতে এখন তাঁর বাম পা অবশ হয়ে গেছে। কোনো শক্তি পান না, হাঁটা–চলাও করতে পারেন না।
শুকুম আলী চৌকিদার (৪১) শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ডিঙ্গামানিক ইউনিয়নের জালিয়া হাটি গ্রামের বাসিন্দা। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হিসেবে জানত এলাকার সবাই। সেই শুকুম আলীকে এখন থাকতে হচ্ছে শিকলবন্দী অবস্থায়। ১০ বছর ধরে ৫ ফুট শিকলে আটকে যাওয়া জীবন কাটাতে তাঁর একটি পা অবশ হয়ে গেছে। এখন হাঁটা-চলাও করতে পারেন না।

পরিবার ও গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুকুম আলীর জন্ম ১৯৭৯ সালে। শিশু বয়স থেকেই তিনি বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। ৮ বছর আগে বাবা আবুল হাসেম চৌকিদার মারা যান। মা আনোয়ারা বেগম মারা যান ১৪ বছর আগে। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হলেও শুকুম আলী ২০০৯ সাল পর্যন্ত বাবা ও ভাইদের সঙ্গে কৃষিশ্রমিকের কাজ করতেন। ২০০৯ সালে একদিন শুকুম বাড়ি থেকে নিখোঁজ হন। এক বছর পর ঢাকার কেরানীগঞ্জে অসুস্থ অবস্থায় তাঁকে খুঁজে পান স্বজনেরা। স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৫ দিন চিকিৎসা দেওয়ার পর শুকুমকে বাড়িতে নেওয়া হয়। এরপরই পরিবারের সদস্যরা তাঁকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখার সিদ্ধান্ত নেন।

এলাকাবাসী জানান, প্রথম দিকে বাড়ির উঠানে গাছের সঙ্গে, বারান্দার দরজা-জানালার সঙ্গে তাঁকে বেঁধে রাখা হতো। তাঁর এমন কষ্ট দেখে ওই গ্রামের বাসিন্দা মালয়েশিয়াপ্রবাসী মুকুল আকন বাড়ির সামনে সড়কের পাশে টিন ও মেঝে পাকা করে চারদিকে খোলা ঘর নির্মাণ করে দেন। তিন বছর ধরে সেই ঘরেরই বাসিন্দা শুকুম আলী। শুকুম আলীরা তিন ভাই। বড় ভাই মোতালেব চৌকিদার ও মেজ ভাই লোকমান চৌকিদার। শুকুম আলীকে দেখাশোনা করেন মেজ ভাই লোকমান চৌকিদার। তাঁর (লোকমান) স্ত্রী পারুল বেগম তাঁকে খাইয়ে দেওয়া, গোসল করানো, ঘরে আনা-নেওয়া করাসহ সব কাজ করে দেন।

১০ বছর ধরে এভাবেই শিকলে বেঁধে রাখা হয় শুকুম আলীকে। গতকাল বুধবার নড়িয়ার জালিয়াহাটি গ্রামে।
প্রথম আলো

বুধবার (২৬ আগস্ট) জালিয়াহাটি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, টিনের একটি খোলা ঘরের খুঁটির সঙ্গে শুকুম আলীকে শিকল দিয়ে তালা লাগিয়ে রাখা হয়েছে। সেখানেই বসে ভাতিজার মুঠোফোনে গান শুনছেন। কিছু সময় পরই মেজ ভাইয়ের মেয়ে খাবার নিয়ে আসে। মুহূর্তের মধ্যেই গোগ্রাসে খাবার খেয়ে নেন। এর কিছু সময় পর বালতিতে পানি নিয়ে আসেন তাঁর ভাবি পারুল বেগম। তিনি তাঁর কাপড় পরিবর্তন করে দিয়ে গোসল করিয়ে দেন। এ কাজগুলো করার সময় শুকুমকে ধরে সহায়তা করতে হয়েছে। বাম পা অবশ থাকার কারণে তিনি দাঁড়াতে পারছিলেন না।
পারুল বেগম বলেন, ‘আমি এ বাড়িতে বউ হয়ে আসার পর থেকেই ওর যত্ন করি। সন্তানের স্নেহে তাকে আগলে রেখেছি। বোকাসোকা মানুষ, হারিয়ে যাবে, মানুষ তাকে মারধর করবে, এমন আশঙ্কায় তাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে।’

ওই গ্রামের বাসিন্দা স্থানীয় পণ্ডিতসার উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক দ্বিজয় দাশ আচার্য প্রতিদিন শুকুম আলীদের বাড়ির সামন দিয়ে যাতায়াত করেন। যাতায়াতের পথে প্রতিদিনই তিনি তাঁর সঙ্গে সময় কাটান, গল্প করেন, বিভিন্ন খাবার এনে দেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, শুকুম আলী মানসিক বা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হলেও কাউকে উৎপাত করেন না। প্রতিদিনই তাঁর সঙ্গে তিনি সময় কাটান, গল্প করেন। পারিবারিক দারিদ্র্যের কারণে তাঁকে উন্নত চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়নি। তাঁর চিকিৎসা করাতে পারলে হয়তো সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারতেন।

শুকুম আলী মানসিক বা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হলেও কাউকে উৎপাত করেন না। প্রতিদিনই তাঁর সঙ্গে তিনি সময় কাটান, গল্প করেন। পারিবারিক দারিদ্র্যের কারণে তাঁকে উন্নত চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়নি। তাঁর চিকিৎসা করাতে পারলে হয়তো সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারতেন।
দ্বিজয় দাশ আচার্য, শিক্ষক, পণ্ডিতসার উচ্চবিদ্যালয়

শুকুম আলীর ভাই লোকমান চৌকিদার বলেন, ‘আমি কৃষিশ্রমিকের কাজ করি। ওই আয়ে সংসার চালাতে কষ্ট হয়। শুকুম আলীকে কীভাবে উন্নত চিকিৎসা করাব? সমাজসেবা অধিদপ্তর ২০১৪ সাল থেকে তাকে প্রতিবন্ধী ভাতা দেয়। কিন্তু তাকে চিকিৎসা করানোর বিষয়ে কেউ সহায়তা করে না।’
জানতে চাইলে নড়িয়ার ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তানভির আল নাসিফ প্রথম আলোকে বলেন, একজন মানুষ শিকলবন্দী জীবন কাটাবে, এটা খুব বেদনাদায়ক। বিষয়টি তাঁদের নজর আসেনি। ওই যুবকের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁর বিষয়ে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
শরীয়তপুর জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক কামাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, শিকলবন্দী জীবন কাটানোর বিষয়ে তাঁরা জানতেন না। খোঁজ নিয়ে জেনেছেন ওই যুবককে প্রতিবন্ধী ভাতা দেওয়া হচ্ছে। তাঁর পরিবার তাঁকে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা করালে সমাজসেবা কার্যালয় চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করবে। এ ছাড়া জেলা সমাজকল্যাণ পরিষদে আবেদন করলে তাঁকে আর্থিকভাবেও সহায়তা করা হবে।