শিক্ষক অপদস্থের ১১ দিনেও যেসব প্রশ্নের উত্তর নেই

এক শিক্ষক ঘটনা উসকে দিয়েছিলেন বলে জেলা প্রশাসনের সভায় অভিযোগ। তিনি স্থানীয় বিছালি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি।

শিক্ষক হেনস্তা ও হত্যার প্রতিবাদে মানববন্ধনে এক শিক্ষার্থী। গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে
ছবি: সাজিদ হোসেন

নড়াইল সদর উপজেলার মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে অপদস্থ করার ঘটনায় ‘জড়িত’ আরও দুজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। পুলিশ বলছে, এই দুজন সরাসরি জুতার মালা পরানোর সঙ্গে জড়িত। তাঁদের একজনকে গত রাতে খুলনা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এর আগে তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের একজন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জুতার মালা পরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ।

অবশ্য ঘটনাটি নিয়ে নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কারা শুরুতে অভিযুক্ত শিক্ষার্থীকে নিয়ে যেতে পুলিশকে বাধা দিয়েছে, কারা ‘ফোন করে’ বিপুলসংখ্যক মানুষকে জড়ো করেছে, কারা জুতা সংগ্রহ করে মালা তৈরি করেছে, এসব প্রশ্নের উত্তর জানা জরুরি।

প্রশ্ন তৈরি হয়েছে কলেজেরই এক শিক্ষকের ভূমিকা নিয়েও। আকতার হোসেন নামের ওই শিক্ষক স্থানীয় বিছালি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি। অভিযোগ উঠেছে, তিনি উপস্থিত লোকজনকে নিবৃত্ত করেননি; বরং উসকে দিয়েছেন।

নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে ১৮ জুন জুতার মালা পরিয়ে অপদস্থ করা হয়। এ সময় নড়াইল জেলা প্রশাসক (ডিসি), পুলিশ সুপার (এসপি) ও বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্য উপস্থিত ছিলেন। ঘটনার পর থেকে স্বপন কুমার বিশ্বাস বাড়িছাড়া। এ ঘটনায় দেশের বিশিষ্ট নাগরিকেরা ও বিভিন্ন সংগঠন প্রতিবাদ জানিয়ে কর্মসূচি পালন করছে এবং বিবৃতি দিয়েছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গতকাল বুধবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘এই ঘটনায় আমরা সত্যিই দুঃখিত।’ তিনি বলেন, জেলা প্রশাসক ও পুলিশের কোনো গাফিলতি আছে কি না, কার কতখানি অবহেলা রয়েছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। জনপ্রতিনিধির ভূমিকা কী ছিল, সেটাও দেখা হচ্ছে।

শনাক্ত ব্যক্তিরা কারা

সূত্র জানিয়েছে, শিক্ষককে অপদস্থের ঘটনার ভিডিও ফুটেজ দেখে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে, তিনজন সরাসরি জুতার মালা পরিয়েছিলেন। তাঁদের একজন মো. শাওন খান (২৮)। তিনি জুতার মালা হাতে করে কলেজ মাঠের মধ্য দিয়ে ঘটনাস্থলে নিয়ে যান। এরপর আরও দুজনের সঙ্গে অধ্যক্ষের গলায় সেটি পরিয়ে দেন। শাওন মির্জাপুর বাজারে ফ্লেক্সিলোডের দোকান চালান।

পুলিশ জানিয়েছে, শাওন ছাড়া অন্য দুই যুবক হলেন মির্জাপুর ইউনিয়নের রুহখালী গ্রামের রনি ও সোয়েব। রনি খুলনার সরকারি বিএল কলেজের স্নাতক শেষ বর্ষের ছাত্র। তাঁকে খুলনা থেকে গত রাতে গ্রেপ্তার করা হয়। সোয়েব যশোরের অভয়নগর উপজেলার সিঙ্গাড়ি আবদুল হক ডিগ্রি কলেজে পড়েন।

পুলিশ এর আগে সোমবার রাতে শাওন খানসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। বাকি দুজন হলেন নড়াইল সদর থানা যুবদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মনিরুল ইসলাম ওরফে রুবেল এবং ইজিবাইকের চালক সৈয়দ রিপন আলী। তিনজনেরই বাড়ি মির্জাপুর গ্রামে।

মনিরুল ইসলাম স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতাও করেন। তিনি হ্যান্ডমাইকে বক্তব্য দিয়ে ঘটনা উসকে দিতে ভূমিকা রাখেন বলে অভিযোগ।

শিক্ষককে অপদস্থের ঘটনায় হওয়া মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও নড়াইল সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. মাহামুদুর রহমান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, শাওন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে অধ্যক্ষের গলায় জুতার মালা পরানোর কথা স্বীকার করেছেন। গ্রেপ্তার হওয়া তিনজনের পাঁচ দিনের রিমান্ড চেয়ে করা আবেদন গতকাল আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে। শুনানি হবে ৩ জুলাই।

আরেক শিক্ষকের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন

শিক্ষককে অপদস্থের ঘটনার পর গত রোববার নড়াইল জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা বিষয়ে এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সূত্র জানায়, সেখানে অভিযোগ করা হয় যে কলেজটির শিক্ষক ও বিছালি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আকতার হোসেন অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের বিরুদ্ধে ছাত্র ও লোকজনকে উসকে দিয়েছেন।

সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন নড়াইল জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান। সেখানে পুলিশ সুপার প্রবীর কুমার রায় এবং রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি ও নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ ছিলেন।

জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ওই সভায় আকতার হোসেনের বিরুদ্ধে উসকানি দেওয়ার অভিযোগ উঠে এসেছে। বিষয়টি তদন্ত হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৫ থেকে ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত আকতার হোসেন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ছিলেন। বিধি অনুযায়ী অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষের অনুপস্থিতিতে ১ নম্বর জ্যেষ্ঠ শিক্ষক অধ্যক্ষের দায়িত্বে থাকবেন। আকতার হোসেন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক না হওয়ায় কলেজের একজন শিক্ষকের অভিযোগের ভিত্তিতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর জ্যেষ্ঠ শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসকে অধ্যক্ষের দায়িত্ব দিতে নির্দেশনা দেয়। সেই থেকে স্বপন কুমার বিশ্বাস অধ্যক্ষের দায়িত্বে আছেন। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ ছিলেন আকতার হোসেন।

ওই এলাকার একজন জনপ্রতিনিধি ঘটনার পুরো সময় উপস্থিত ছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার দিন শুরুতেই ছাত্রদের নিবৃত্ত করতে পারতেন শিক্ষক আকতার হোসেন। বরং দেখা গেছে বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা বারবার তাঁর সঙ্গে কথা বলেছে। দুপুরের পর থেকে অধ্যক্ষের অপসারণ দাবি করা হয়। বিকেলে তাঁকে অপদস্থ করা হয়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, কলেজের গ্যারেজে তিনজন হিন্দু শিক্ষকের মোটরসাইকেলের সঙ্গে আকতার হোসেনের মোটরসাইকেলটিও ছিল। সেটি সরিয়ে নেওয়ার পর তিন হিন্দু শিক্ষকের মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেওয়া হয়।

আকতার হোসেন মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সারা দিন আমি ছাত্র ও বিক্ষুব্ধ জনতাকে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ অবান্তর।’ তিনি আরও বলেন, ‘পরিস্থিতি খারাপ দেখে একজন শুভাকাঙ্ক্ষী আমার মোটরসাইকেল সরিয়ে আনে।’

শিক্ষককে অপদস্থ করার ঘটনার শুরু একটি ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে। কলেজেরই একাদশ শ্রেণির এক শিক্ষার্থী ভারতের বিজেপির বহিষ্কৃত মুখপাত্র নূপুর শর্মাকে প্রণাম জানিয়ে ১৭ জুন পোস্টটি দিয়েছিল। পরদিন অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস কলেজের শিক্ষক, ওই শিক্ষার্থীর বাবা ও কলেজ পরিচালনা পরিষদের কয়েকজন সদস্যকে ডেকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ওই শিক্ষার্থীকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। কিন্তু শিক্ষার্থীকে নিয়ে যেতে পুলিশকে বাধা দেওয়া হয়। অপদস্থ করা হয় শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসকে।

নড়াইল সদর থানার ওসি মোহাম্মদ শওকত কবীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিক্ষুব্ধরা অতি উৎসাহী ছিল। তবে ঘটনায় অধ্যক্ষবিরোধী শিক্ষকদের উসকানি থাকতে পারে বলে সন্দেহ আছে।’