শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে একাত্মতা, ৯ মাস পর চার শিক্ষককে কারণ দর্শানোর নোটিশ

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

বেতন-ফি কমানো, আবাসনসংকটের সমাধান, দ্বিতীয় পরীক্ষণের ব্যবস্থা করা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপন্থী অধ্যাদেশের সংস্কার বা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগের সুরাহা—৯ মাস আগে এমন কিছু দাবিতেই উত্তাল হয়ে উঠেছিল খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার্থীদের ওই আন্দোলনে তখন একাত্মতা প্রকাশ করেছিলেন সেখানকার বেশ কিছু শিক্ষক। ৯ মাস আগের ওই আন্দোলনের সূত্র ধরে চার শিক্ষককে কারণ দর্শানোর (শোকজ) নোটিশ পাঠিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
ঘটনার এত দিন পরে ব্যাখ্যা চাওয়ার বিষয়টিকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করছেন নোটিশ পাওয়া শিক্ষকেরা। আর বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমান প্রশাসনের বিরোধী হিসেবে পরিচিত শিক্ষকদের অভিমত, কোনো প্রকার তদন্ত ছাড়া সরাসরি এ ধরনের সিদ্ধান্তে আসা প্রশাসনের দুরভিসন্ধিরই অংশ।
নোটিশ পাওয়া ওই চার শিক্ষক হলেন বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. আবুল ফজল, প্রভাষক শাকিলা আলম, ইতিহাস ও সভ্যতা বিভাগের প্রভাষক হৈমন্তী শুক্লা কাবেরী ও ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক আয়েশা রহমান আশা। ১৩ অক্টোবর তাঁদের নোটিশ দিয়ে তিন দিনের মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়। পরে তাঁরা জবাব দেওয়ার জন্য পৃথকভাবে সময় চেয়ে আবেদন করেন। নোটিশ পাওয়া শিক্ষকেরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা অসংগতির বিরুদ্ধে তাঁরা বিভিন্ন সময় যৌক্তিক প্রতিবাদ করেছেন। এ জন্যই তাঁদের ‘শায়েস্তা’ করতে এই শোকজ।

যে আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে এই নোটিশ, সেটির সূত্রপাত ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে। সেই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের আরও দাবির মধ্যে ছিল খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়কে সাংস্কৃতিক অবরুদ্ধতা থেকে মুক্তি ও মুক্তচিন্তা বিকাশে অধ্যাদেশের ব্যবস্থা করা, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যের উৎকর্ষ সাধন, অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে অবকাঠামো নির্মাণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণে শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভুক্তিকরণ এবং অবহিতকরণ ইত্যাদি। এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের ১ জানুয়ারি শিক্ষার্থীরা ফের বিক্ষোভে নামেন ক্যাম্পাসে। ওই দিন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। একপর্যায়ে প্রশাসন ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেন তাঁরা।
১৩ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক খান গোলাম কুদ্দুস স্বাক্ষরিত কারণ দর্শানোর নোটিশে বলা হয়েছে, ২ জানুয়ারি আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ প্রশাসনিক ভবনে তালা মেরে উপাচার্যসহ অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবরুদ্ধ করে রাখেন। এর ফলে প্রশাসনিক ভবনে কর্মরতদের মধ্যে বিশেষ করে নারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া প্রশাসনিক কাজে বিঘ্ন ঘটে ও ভবনে যাতায়াত ব্যাহত হয়। স্বাভাবিক একাডেমিক কার্যক্রম ব্যাহত করা, শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের অসৌজন্যমূলক আচরণ, প্রশাসনিক ভবন তালাবদ্ধ করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আটকে রাখা ও ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা ছিল বেআইনি, অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্ক্ষিত।

নোটিশে চার শিক্ষককে বলা হয়েছে, ‘এই বিষয়গুলো সঙ্গে আপনার সংশ্লিষ্টতা ছিল বলে কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। এ বিষয়ে তিন কর্মদিবসের মধ্যে ব্যাখ্যা প্রদানের জন্য অনুরোধ জানানো হলো।’
নোটিশ পাওয়া শিক্ষকদের একজন মো. আবুল ফজল বলেন, ‘ঘটনার এত দিন পর প্রশাসনের এমন চিঠি পেয়ে আমরা হতবাক। চিঠি পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে অপমানবোধ করেছি। শিক্ষার্থীরা যে দাবিতে আন্দোলন করছিলেন, তা ছিল সাংবিধানিক ও মৌলিক অধিকারের। এ কারণেই আমরা শিক্ষকেরা সেখানে সমর্থন দিয়েছি। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও কিছু অসংগতির বিরুদ্ধেও আমরা কয়েকজন শিক্ষক সোচ্চার ছিলাম।’
শিক্ষার্থীদের ওই আন্দোলনকে ‘বিশ্ববিদ্যালয় অশান্ত করার ষড়যন্ত্র’ হিসেবে দেখছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। আন্দোলন চলাকালে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে প্রশাসনের অনুগত বলে পরিচিত অন্তত সাতজন শিক্ষকের সঙ্গে সে সময় কথা হয়েছিল প্রথম আলোর। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই শিক্ষকেরা আন্দোলনের পেছনে কয়েকজন শিক্ষকের প্ররোচনাকে দায়ী করে বলেছিলেন, সমাবর্তনের আগে এসব শিক্ষক পরিস্থিতি উত্তপ্ত করতে চেয়েছিলেন। সেটি সম্ভব না হওয়ায় এখন তাঁরা শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করছেন।
সে সময় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক বক্তব্যও প্রকাশ করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক এস এম আতিয়ার রহমান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, ‘আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ১ জানুয়ারি বেলা ১১টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে গেটের বাইরে অবস্থান করে নানা ধরনের স্লোগান দিতে থাকেন। বেলা সোয়া দুইটার দিকে শিক্ষার্থীদের সামনে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ সম্পর্কে জানাতে হাজির হন বিশ্ববিদ্যালয়ের সব অনুষদের ডিন, রেজিস্ট্রার ও ছাত্রবিষয়ক পরিচালক। কিন্তু আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ডিনদের কোনো কথাই শুনতে চাননি। কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থী ডিনদের সঙ্গে যে আচরণ করেছেন, তা সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত, অশোভন, অত্যন্ত দুঃখজনক ও উদ্বেগের।’

ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, ‘বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আরও উদ্বিগ্ন এ কারণে যে কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থীর ওই আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক তাঁদের সরাসরি ইন্ধন দিচ্ছেন এবং নানাভাবে তাঁদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছেন। এমনকি তাঁদের মধ্যে কয়েকজন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সামনে সরাসরি হাজির হয়ে বক্তব্যও দেন, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে নজিরবিহীন।’
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের বিবৃতি
চার শিক্ষককে এই শোকজের ঘটনায় বিবৃতি দিয়েছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘সম্প্রতি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন অত্যন্ত অগ্রহণযোগ্য ও হাস্যকরভাবে চারজন শিক্ষককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে। অজুহাত হিসেবে প্রশাসনের ভাষ্য, ওই শিক্ষকেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ক্ষুণ্ন করেছেন। আসলে তাঁরা যা করেছিলেন, তা ছিল শিক্ষার্থীদের মৌলিক কিছু চাহিদার যৌক্তিক দাবির পক্ষে শিক্ষকদের পক্ষ থেকে একাত্মতা প্রকাশ করা, যা যেকোনো সচেতন শিক্ষকের কর্তব্য বলে আমরা মনে করি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মেলবন্ধনেই জ্ঞানের চর্চা অগ্রসর হয়ে থাকে। এই বিষয়টি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অজানা কি না, তা ভেবে আমরা বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ হচ্ছি।’

বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ‘আন্দোলনকালে শিক্ষার্থীদের উত্থাপিত দাবিগুলোর কোনোটাই অন্যায় কোনো দাবি নয়। বরং তা অত্যন্ত ন্যায়সংগত এবং এসব তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। যেকোনো বিবেকবান মানুষ শিক্ষার্থীদের এই দাবির পক্ষে থাকার কথা এবং উক্ত শিক্ষকেরা সেটাই করেছে। এ জন্য তাঁদেরকে আমরা সাধুবাদ জানাতে চাই। কিন্তু বিস্ময়করভাবে লক্ষ করা গেল, প্রশাসন মৌলিক দাবির আন্দোলনকে কিনা তাদের অসম্মানের বিষয় বলে ভাবছে। যেখানে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান নির্ভর করে, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞান ও মুক্তচিন্তার চর্চায়, তারা কতটুকু উন্নত, সেটার ওপর। অথচ গণতান্ত্রিক আন্দোলন নাকি তাদের জন্য লজ্জার! আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, আপনাদের এহেন বিতর্কিত ভূমিকা জন্যই বরং আমরা লজ্জিত।’

বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, ‘শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ঘটনার পর প্রায় তিন মাস বিশ্ববিদ্যালয় খোলা থাকার পরেও এখন এই প্রায় ৯ মাস পর উক্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হলো। এ আন্দোলনে আরও অনেক সম্মানিত শিক্ষক সমর্থন জানালেও সুনির্দিষ্টভাবে এই চারজনকে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে। এটিকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও পূর্ববর্তী কোনো ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ বলেই আমরা আশঙ্কা করছি। উক্ত ছাত্র আন্দোলনের কাছাকাছি সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে একজন নারী নিয়োগপ্রার্থীর সঙ্গে যৌন নিগ্রহমূলক আচরণের অভিযোগ উঠেছিল। আমরা খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি, উক্ত ইস্যুতেও এই চার শিক্ষক নৈতিকভাবে অভিযোগকারী নারীর পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। তাই ঘটনা পরম্পরা হিসেবে এই কারণ দর্শানোর নোটিশে সুনির্দিষ্ট করে উক্ত চারজনকে অভিযুক্ত করার এহেন প্রক্রিয়াটিকে একটি প্রতিহিংসামূলক পদক্ষেপ হিসেবেও ভাবার অবকাশ আছে বলে আমরা উদ্বেগ প্রকাশ করছি।’
বিবৃতিটিতে সই করেছেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, অধ্যাপক গীতিআরা নাসরীন, অধ্যাপক স্বাধীন সেন, অধ্যাপক মানস চৌধুরী, অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস, অধ্যাপক ফাহমিদুল হক, অধ্যাপক কাবেরী গায়েন, অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীম উদ্দিন খান, সহযোগী অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন, সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা, সহযোগী অধ্যাপক দীনা এম সিদ্দিকী, সহকারী অধ্যাপক কাজলী শেহরীন ইসলাম প্রমুখ।