শীত সামনে রেখে নাটোরে কুমড়াবড়ি বানানোর ধুম

শীত সামনে রেখে কুমড়াবড়ি তৈরিতে তাই ব্যস্ত সময় পার করছেন নারীরা। মঙ্গলবার দুপুরে নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলার ব্রহ্মপুর ইউনিয়নের ঝুপদুয়ার গ্রামেপ্রথম আলো

নাটোর অঞ্চলের মুখরোচক খাবারের মধ্যে ‘কুমড়াবড়ি’ অন্যতম। খালবিলের দেশীয় প্রজাতির মাছ দিয়ে কুমড়াবড়ির তরকারি রান্না এখানকার ঐতিহ্য। তবে শীতের সময়টাতেই কুমড়াবড়ি খাওয়ার প্রচলন বেশি দেখা যায়। আর তাই শীতে বাজারে এর চাহিদাও যায় বেড়ে। শীত সামনে রেখে নাটোরের চলনবিল ও হালতিবিল পারের ঘরে ঘরে কুমড়াবড়ি বানানোর ধুম পড়েছে। তবে করোনা পরিস্থিতিতে এবার বেচাকেনা কেমন হবে, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন কুমড়াবড়ি তৈরি ও ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

চলনবিল ও হালতিবিল অধ্যুষিত উপজেলা নাটোরের সিংড়া ও নলডাঙ্গা। সিংড়ার কলম ও নলডাঙ্গার ব্রহ্মপুর ইউনিয়নের শত শত পরিবার কুমড়াবড়ি তৈরির সঙ্গে জড়িত অনেক কাল ধরে। তবে আগে নিজেদের খাওয়ার জন্য বাড়ির বউরা কুমড়াবড়ি তৈরি করলেও শীতে অভাবে পড়া পরিবারগুলো ঘরে অন্নসংস্থানের জন্য হাটবাজারে কুমড়াবড়ি বিক্রির পথ ধরে। ক্রমে এটি পরিবারের বাড়তি উপার্জনের পথ হিসেবে জনপ্রিয়তা পায়। ফলে এখন দুই উপজেলার কয়েক শ পরিবারের বানানো কুমড়াবড়ি নাটোর ছাড়াও ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।

কুমড়াবড়ি তৈরি হয় মূলত চালকুমড়া বা জালিকুমড়ার সঙ্গে ডালবাটা মিশিয়ে। স্বাদ বাড়ানোর জন্য কেউ কেউ কালিজিরা বা সামান্য মসলা মিশিয়ে কুমড়াবড়ি তৈরি করেন। ডাল-কুমড়ার মিশ্রণ হাতে গোল গোল বল বা বড়ির আকৃতি করে বাঁশের বানা, কুলা–চালুন বা বড় থালায় বসিয়ে দেওয়া হয়। এরপর শুকানো হয় রোদে। বড়ি রোদে শুকিয়ে প্রস্তুত হতে ৮-১০ দিন লেগে যায়। সবজি ও মাছ রান্নায় অনুষঙ্গ হিসেবে এই কুমড়াবড়ির ব্যবহার বাঙালির ঘরে জনপ্রিয়। এতে তরকারির স্বাদও বহুগুণ বেড়ে যায়।

বর্তমানে কুমড়াবড়ি প্রতি কেজি ১৮০ থেকে ২২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। কাদাপানির দেশীয় মাছ, যেমন ট্যাংরা, শোল, টাকি, গুচি, বাইন ও বোয়াল মাছ দিয়ে কুমড়াবড়ি রান্না করলে লোকের জিহ্বায় জল চলে আসে।

মঙ্গলবার সকালে সরেজমিনে হালতিবিলপারের ব্রহ্মপুর ইউনিয়নের ঝুপদুয়ার গ্রামে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই কুমড়াবড়ি তৈরির যেন মহোৎসব লেগেছে। বাড়ির নারী সদস্যরা তো বটেই, পুরুষেরাও অন্য কাজে না গিয়ে কুমড়াবড়ি তৈরির পেছনে সময় দিচ্ছেন। সেখানকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গ্রামটিতে ৪০ ঘর লোকের বাস। এদের মধ্যে ৩৮টি পরিবারই হিন্দু সম্প্রদায়ের। এই হিন্দু সম্প্রদায়ের পরিবারগুলোই অনেক কাল ধরে কুমড়াবড়ি তৈরির সঙ্গে জড়িত। তাদের বানানো কুমড়াবড়ি স্বাদেও অতুলনীয়।

বাঁশের বানায় রোদে শুকাতে দেওয়া হয়েছে কুমড়াবড়ি। মঙ্গলবার দুপুরে নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলার ব্রহ্মপুর ইউনিয়নের ঝুপদুয়ার গ্রামে
প্রথম আলো

গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে নারীদের ব্যস্ততা লক্ষ করার মতো। রাতে পানিতে ভিজিয়ে রাখা মাষকলাইয়ের ডাল সূর্যোদয়ের আগেই শিলপাটায় বাটতে শুরু করেছেন তাঁরা। সেই ডালের সঙ্গে পরিপক্ব চালকুমড়ার শাঁস আবার বেটে ভালোভাবে মিশিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এই ডাল-কুমড়ার মিশ্রণ সবশেষে বাঁশের বানা বা খলসুনের গায়ে ছোট ছোট বড়ির আকৃতি করে বসিয়ে দিচ্ছেন। এগুলো শুকাতে দিচ্ছেন রোদে।

ঝুপদুয়ার গ্রামের কুমড়াবড়ি ব্যবসায়ী শ্রীকৃষ্ণ প্রামাণিক জানান, একসময় বিলে মাছ মেরে তাঁদের সংসার চলত। তবে শীতে পানি শুকিয়ে গেলে দুমুঠো খাবারও মিলত না। এমন পরিস্থিতিতে বাড়ির নারীরা কুমড়াবড়ি তৈরি করে বিক্রি করতে শুরু করেন। বাজারে-দোকানে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে তাঁদের তৈরি কুমড়াবড়ি। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বড়ির চাহিদা আসে। সময়মতো সরবরাহ নিশ্চিত করতে গিয়ে পরিবারের পুরুষেরাও বড়ি তৈরিতে যুক্ত হন। এখন গ্রামের ৩৮টি হিন্দু পরিবারের আয়ের প্রধান উৎসই কুমড়াবড়ি। ব্যাপক চাহিদা থাকায় তাঁদের বেচাকেনাও ভালোই হয়। বাড়তি উপার্জনে সবার সংসারে অভাব ঘুচতে শুরু করেছে।

চালুনে করে রোদে শুকাতে দেওয়া হয়েছে কুমড়াবড়ি। মঙ্গলবার দুপুরে নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলার ব্রহ্মপুর ইউনিয়নের ঝুপদুয়ার গ্রামে
প্রথম আলো

শ্রীকৃষ্ণ প্রামাণিক আরও জানান, করোনা পরিস্থিতিতে হাটবাজার বন্ধ থাকায় বেচাবিক্রি কম হয়েছে, তাই অভাব-অনটনও বেড়ে গেছে। শীত আসছে, বড়ির চাহিদা বাড়বে। সবকিছু ঠিক থাকলে গত কয়েক মাসের লোকসান পোষানো যাবে। তা যদি না হয়, তাহলে বিকল্প আয় কী হবে, তা ভেবে তাঁরা উদ্বিগ্ন। শীতে করোনার প্রকোপ বাড়তে পারে, এ খবর পেয়ে তাঁরা দুশ্চিন্তায় সময় পার করছেন।

একই গ্রামের কুমড়াবড়ির পুরোনো ব্যবসায়ী নীরেন চন্দ্র বলেন, যদিও শীতেই কুমড়াবড়ির চাহিদা বেশি থাকে, তবে শহরের লোকজন সারা বছরই পাতে কুমড়াবড়ি খেতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। তাই মুদিদোকানিরা সারা বছরই তাঁদের কাছ থেকে কুমড়াবড়ির অর্ডার দিয়ে রাখেন। যে সময় কুমড়া থাকে না, সে সময় তাঁরা কুমড়ার পরিবর্তে কাঁচা পেঁপে ব্যবহার করেন।

গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে কুমড়াবড়ি প্রতি কেজি ১৮০ থেকে ২২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। ব্রহ্মপুর গ্রামের সাবিত্রী দেবী বলেন, ‘কুমড়াবড়ি দিয়ে নানা পদের রান্না হয়। যেমন শুধু বড়ির ঝোলও করা যায়, আবার বড়ি ও সবজি দিয়ে পুড়পুড়ি বা ঘণ্ট রান্নাও সুস্বাদু হয়। তবে কাদাপানির দেশীয় মাছ, যেমন ট্যাংরা, শোল, টাকি, গুচি, বাইন ও বোয়াল মাছ দিয়ে কুমড়াবড়ি রান্না করলে লোকের জিহ্বায় জল চলে আসে।’

নলডাঙ্গার পরিবেশকর্মী ফজলে রাব্বি জানান, কুমড়াবড়ি মূলত একটা প্রক্রিয়াজাত সবজি। সবার কাছেই এটা জনপ্রিয়। এর উৎপাদন ঘিরে চলনবিল ও হালতিবিল এলাকায় একটা পেশাজীবী শ্রেণি গড়ে উঠেছে। এখানকার কুমড়াবড়ি দেশের বাইরেও যাচ্ছে। তাই এর অর্থনৈতিক অবদানও গুরুত্বপূর্ণ।

সিংড়ার কলম এলাকার বাসিন্দা কামরুল হাসান জানান, কুমড়াবড়ির দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা করা যায় এবং এর তরকারি সুস্বাদু হওয়ায় এর জনপ্রিয়তা সর্বজনীন হয়ে গেছে।