শেষ কর্মদিবসে উপাচার্য সোবহানকে বিদায় জানাতে আসেননি কেউ

সকাল থেকেই ক্যাম্পাসে ছিল টানটান উত্তেজনা
ছবি: প্রথম আলো

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আবদুস সোবহানের দ্বিতীয় মেয়াদের শেষ দিন ছিল টানটান উত্তেজনা ছড়ানো। হয়েছে সংঘর্ষও। এদিন যেতে পারেননি নিজ কার্যালয়েও। তাঁকে বিদায় শুভেচ্ছা জানাতেও কেউ আসেননি। আগে-পিছে পুলিশের গাড়ি পাহারায় আজ বৃহস্পতিবার বেলা সোয়া ২টার দিকে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিদায় নেন।

বিদায়বেলায় নিয়োগ দেওয়ার ইস্যু নিয়ে আগের দিন থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তেজনা ছিল। এ জন্য শেষ দিনটির দিকে গণমাধ্যমের কর্মীরা সকাল থেকেই নজর রাখছিলেন।

রাত থেকেই অবস্থান নিয়েছিল ছাত্রলীগ

বৃহস্পতিবার সকাল ৫টা ৪০। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে পুলিশের দুটি গাড়ি দাঁড়িয়ে। চালকসহ দুই গাড়ির পুলিশের সদস্যরা সবাই ঘুমিয়ে রয়েছেন। ভেতরের আসনের পুলিশ সদস্যরাও সটান শুয়ে আছেন। এই ছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আবদুস সোবহানের শেষ কর্মদিবসে তাঁর বাসভবনের সামনের সকালের চিত্র।

সকাল ছয়টার দিকে রাজশাহী মহানগর সিটি এসবির দুজন সদস্য ডিউটি করতে এলেন। সাড়ে ছয়টার দিকে রিকশায় করে ক্যাপ পরা একজন লোক এসে নামলেন। দারোয়ান গেট খুলে দিলে তিনি বাসার ভেতরে ঢুকে গেলেন। পৌনে সাতটার দিকে ভেতর থেকে পুলিশের বিশেষ শাখার একজন সদস্য বের হলেন। তাঁর কাছ থেকে জানা যায়, রাত দেড়টা থেকে পৌনে তিনটা পর্যন্ত ছাত্রলীগের একটা অংশ বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়েছিল। পরে নিয়োগের ইতিবাচক ইঙ্গিত পেয়ে তারা চলে যায়।

সকাল ৭টা ২০ মিনিটের দিকে পুলিশের গাড়ি দুটি বাসার সামনে থেকে চলে যায়। বাসার সামনে তখন ফাঁকা। সাড়ে সাতটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে একজন নারী এসে ভেতরে ঢুকলেন। পুলিশের বিশেষ শাখার এক সদস্য জানালেন, ওই নারী বাসার কাজের মেয়ে। এর কয়েক মিনিট পরই বাইসাইকেলে চড়ে বাগানের দুজন মালি এসে যথারীতি ভেতরে ঢুকলেন। সেই সঙ্গে পুলিশের একটি গাড়ি এসে দাঁড়াল। এরা দিনের পার্টি। গাড়িতে পুলিশের ছয়জন সদস্য। এরপর আরও দুজন মহানগর পুলিশের বিশেষ শাখার সদস্য এলেন।

মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতির নেতৃত্বে নেতা–কর্মীদের মহড়া
ছবি: প্রথম আলো

শুরু হলো মহড়া

সকাল সোয়া আটটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের ৮-১০ জনের একটি দল মোটরসাইকেলে বাসভবনের সামনে দিয়ে মহড়া দেয়। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে চশমা পরা একজন লোক এলেন। তিনি বাসভবনের অফিসে কাজ করেন। তাঁর পরপরই আরও দুজন মালি এলেন।

সকাল ৯টা ৫০ মিনিটে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিষদ শাখার দপ্তরপ্রধান সহকারী রেজিস্ট্রার মামুন অর রশীদ উপাচার্যের বাসভবনে প্রবেশ করেন। এরপর তিনি একবার বের হয়ে পুলিশের সঙ্গে কথা বলে আবার ভেতরে চলে যান। বেলা ১১টা ৫৪ মিনিটে উপাচার্যের বাসার ফুলের টব নিয়ে একটি মিনি ট্রাক ভেতর থেকে বের হয়ে যায়। ১০ মিনিট পরে একটি হাইয়েস মাইক্রোবাস ভেতর থেকে বের হয়। চালক ছাড়া এ গাড়িতে কাউকে দেখা যায়নি।

সংঘর্ষের সূত্রপাত যেভাবে

দুপুর ১২টার দিকে সহকারী রেজিস্ট্রার মামুন অর রশীদ উপাচার্যের বাসভবন থেকে বের হয়ে আসেন। ইতিমধ্যে বাইরে চাউর হয়ে গেছে, এই সহাকরী রেজিস্ট্রারকে উপাচার্য রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। তখন ‘দুর্নীতিবিরোধী শিক্ষকেরা’ তাঁকে ঘিরে ধরেন। নিয়োগের বিষয়ে কী হয়েছে, বলার জন্য তাঁকে চাপ দেন। তিনি তাঁদের জবাব দিতে বাধ্য নন বলে জানান।

এরই মধ্যে মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতির নেতৃত্বে একটি দল পশ্চিম দিক থেকে উপাচার্যের বাসভবন অতিক্রম করে পূর্ব দিকে যাচ্ছিল। সেখান থেকে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা এসে রেজিস্ট্রারকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এ নিয়ে সংঘর্ষের সূত্রপাত। চাকরিপ্রত্যাশী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের বর্তমান ও সাবেক নেতা-কর্মীরা এগিয়ে আসেন। উভয়ের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে যায়। একপর্যায়ে মহানগর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ধাওয়া খেয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।

পুলিশি পাহারায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ত্যাগ করছেন উপাচার্য এম আব্দুস সোবহান
ছবি: প্রথম আলো

পুলিশি পাহারায় ক্যাম্পাস ছাড়লেন উপাচার্য

বেলা দেড়টার দিকে পুলিশ উপাচার্যের বাসভবনের সামনে থেকে সবাইকে সরিয়ে দেয়। সোয়া ২টার দিকে আগে-পিছে পুলিশের গাড়িসহ একটি গাড়িতে উপাচার্য ও অপর একটি গাড়িতে মালামাল নিয়ে উপাচার্য বের হন। তাঁর গায়ে সবুজ রঙের পাঞ্জাবি ছিল। হাতে মুঠোফোন ধরা ছিল। ওই হাত দিয়েই তিনি হাত নেড়ে সবাইকে শুভেচ্ছা জানান। উপস্থিত সাংবাদিকেরা তাঁর কাজের মূল্যায়ন নিয়ে প্রশ্ন তুললে তিনি বলেন, ‘মূল্যায়ন আপনারা করবেন, দেশবাসী করবে, রাজশাহীর মানুষ করবে।’ নতুন রেজিস্ট্রার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে কি না, জানতে চাইলে উপাচার্য বলেন, ‘না না না। একদম বাজে কথা। এটা মিথ্যা কথা।’ অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা আপনারা পরে জানতে পারবেন।’

তিনি বলেন, তিনি মনে করেন যে তিনি যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো, ভৌত অবকাঠামো, শিক্ষা-গবেষণা ও সংস্কৃতিচর্চা, ক্রীড়া—সর্বক্ষেত্রে উন্নয়ন করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে দায়িত্ব পালনকালে সহযোগিতার জন্য তিনি সাংবাদিকদের ধন্যবাদ জানিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। নিরাপত্তা নিয়ে ভাবছেন কি না, জানতে চাইলে উপাচার্য আবদুস সোবহান বলেন, ‘এ নিয়ে আমি একটুও ভাবিনি। আল্লাহ তায়ালা আছেন। তিনি দেখবেন।’

আরও কিছু প্রশ্ন করতে চাইলে তিনি এই পর্যায়ে সাংবাদিকদের কাছে ক্ষমা চেয়ে সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনোদপুর গেট দিয়ে তাঁর গাড়ি বের হয়ে যায়।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের শেষ দিনে নিয়োগকে কেন্দ্র করে মহানগর ছাত্রলীগের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ ও কর্মকর্তা–কর্মচারীদের সংঘর্ষ হয়
ছবি: শহীদুল ইসলাম

বিদায় জানাতে আসেননি কেউ

আগের দিন বুধবার উপাচার্য ২০-৩০ মিনিটের জন্য নিজ কার্যালয়ে যান। সেখানেই কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের তিনি বিদায় শুভেচ্ছা জানান। শেষ দিনে তিনি আর কার্যালয়ে যাননি। তাঁকে বিদায় শুভেচ্ছা জানাতেও কেউ বাসভবনের সামনে আসেননি। তিনি বের হয়ে যাওয়ার পরই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ে, শেষ সময়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারী পদে ১৪১ জনকে নিয়োগ দিয়েছেন।

গুজবই সত্যি হলো

উপাচার্যের মেয়াদের শেষ দিনে শেষ পর্যন্ত নতুন ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রারের স্বাক্ষরেই অ্যাডহকে ১৪১ জন শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিষদ শাখার দপ্তরপ্রধান সহকারী রেজিস্ট্রার মো. মামুন অর রশীদ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

তবে নিয়োগ আদেশের তালিকায় ও নিয়োগপত্রে তারিখ রয়েছে ৫ মে। অ্যাডহকের মাধ্যমে ৯ জন শিক্ষক, ২৩ জন কর্মকর্তা, ৮৫ জন নিম্নমান সহকারী এবং ২৪ জন সহায়ক কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। উপাচার্যের নির্বাহী আদেশে সংস্থাপন শাখার উপ-রেজিস্ট্রার মো. ইউসুফ আলী নিয়োগপত্রে স্বাক্ষর করেছেন।

নিয়োগপ্রাপ্তদের তালিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সন্তান, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান নেতা-কর্মী ও কয়েকজন সাংবাদিক রয়েছেন বলে জানা গেছে।