শেষ বয়সে রুগ্‌ণ মা, পাশে নেই প্রতিষ্ঠিত সন্তানেরা

অসুস্থ হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকলেও খোঁজ নেননি ছেলেরা। মরিয়ম বেগমের চোখের পানিতে নানা অভিযোগ
ছবি: প্রথম আলো

৯৫ বছর বয়সে এসে রুগ্‌ণ হয়ে পড়েছেন মরিয়ম বেগম। অস্পষ্ট ভাষায় কথা বলেন আর মাঝেমধ্যে হাত দিয়ে চোখের পানি মোছেন। নানা অভিযোগ তাঁর। ভাঙা ভাঙা বাক্যে তিনি বলেন, ‘কী করলাম, আমি কী করলাম! অনেক সম্পদ ছিল। পোলাহানরে আমি ভাত দেই নাই? এহন আমারে ভাত দেয় না। আমারে ভাত দিব না কেন?’

ঢাকার ধামরাই উপজেলার কুশুরা ইউনিয়নের নরসিংহপুরে গ্রামে সাবেক সাংসদ এম এ মালেকের বাড়ির একটি কক্ষে দেখা হয় মরিয়ম বেগমের সঙ্গে। সম্পর্কে সাবেক সাংসদের ফুফু তিনি। ১৫ অক্টোবর স্থানীয় বঙ্গবাজার এলাকার রাস্তার পাশে তাঁকে পড়ে থাকতে দেখে স্থানীয় লোকজন উদ্ধার করে আবদুল লতিফের বাড়িতে নিয়ে যান। পরে খবর পেয়ে মরিয়ম বেগমকে এম এ মালেকের সহধর্মিণী মীনা মালেক পাশেই তাঁদের বাড়িতে নিয়ে যান।

মরিয়ম বেগমের ছয় ছেলে। সবাই প্রতিষ্ঠিত। তাঁদের মধ্যে একজন সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা, দুজন ব্যবসায়ী, একজন চিকিৎসক বিসিএস ক্যাডার। একজন দীর্ঘদিন বিদেশে ছিলেন। আরেকজন চাকরি করতেন, এখন তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ। মরিয়মের দুই মেয়ে। তবে তাঁরা আর্থিকভাবে সচ্ছল নন। ঘটনার পর থেকে মায়ের সঙ্গে বিভিন্ন সময় দেখা করে খোঁজ নিচ্ছেন মেয়েরা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েক স্থানীয় ব্যক্তি জানান, মরিয়ম তাঁর পঞ্চম ছেলেকে বিদেশে যাওয়ার সময় ৩০ শতক জমি লিখে দিয়েছিলেন। ওই জমি বিক্রি করে তিনি বিদেশে যান। এরপর পুনরায় বাড়ি করার জন্য ১০-১২ শতাংশ জায়গা দিয়েছেন। এতে মায়ের ওপর রাগ হন অন্য সন্তানেরা। এর পর থেকেই তাঁরা মায়ের দায়িত্ব নেওয়া প্রায় ছেড়েই দেন। তবে বড় ছেলে ও আরেক ছেলে মায়ের জন্য খরচ দিতেন। কিছুদিন পর থেকে পঞ্চম ছেলেও মায়ের প্রতি আগের মতো আর যত্ন নিচ্ছেন না। বিভিন্ন সময় শারীরিকভাবেও মাকে নির্যাতনের অভিযোগ স্থানীয় লোকজনের।

২০০০ সালে স্বামী আবদুস সালামের মৃত্যুর পর পঞ্চম সন্তানের সঙ্গেই থাকতে শুরু করেন মরিয়ম বেগম। আবদুস সালাম চট্টগ্রামে একটি বেসরকারি বিদেশি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। ১৫ অক্টোবর দুপুরে মরিয়ম বেগম মানিকগঞ্জে ছোট ছেলের কাছে যেতে চান। পঞ্চম সন্তান তাঁকে বাধা দেন। পরে একাই ঘর থেকে বের হয়ে যান মরিয়ম। বাড়ি থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে বঙ্গবাজার এলাকায় রাস্তার পাশে পড়ে যান তিনি। উদ্ধার করে তাঁকে স্থানীয় আবদুল লতিফের বাড়িতে নেওয়া হয়। পরে খবর পেয়ে মীনা মালেক একই এলাকায় তাঁদের বাড়িতে নিয়ে যান।

গত বৃহস্পতিবার সেখানেই কথা হয় মরিয়ম বেগমের সঙ্গে। তাঁর হাত–পায়ের বিভিন্ন স্থানে গভীর ক্ষতের পুরোনো দাগ। এ দাগ আজ শরীর থেকে মনে ছড়িয়ে গেছে। ঘুম থেকে জেগে তাকাতেই হাসিমাখা মুখ মরিয়মের। ইশারায় কাছে টেনে নিলেন। একটু পর পাশ ফিরে পাশেই জাহানারা বেগমকে অস্পষ্ট ভাষায় কিছু বলতে শুরু করলেন।
জাহানারা বেগম দীর্ঘদিন ধরে মরিয়ম বেগমের সঙ্গে রয়েছেন। সেবা–শুশ্রূষাসহ বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করতেন তিনি। জাহানারা বেগম জানালেন, অসুস্থ মরিয়ম ভেবেছিলেন, ছেলেরা এসেছেন, তাই খুশি হয়েছিলেন। পরে কারা এসেছেন, সেটিই জানতে চেয়েছেন।

বিষয়টি জানার পর ওনার ছেলেদের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। তাঁরা এ ব্যাপারে আন্তরিক নন। স্থানীয় পর্যায় থেকে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।
হোসাইন মোহাম্মদ হাই জকী, ধামরাই উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা

শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে মরিয়ম বেগমকে গত শুক্রবার বিকেলে ধামরাই উপজেলার কাওয়ালীপাড়া গ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সুস্থ বোধ করায় রোববার তাঁকে আবারও এম এ মালেকের বাসায় নেওয়া হয়। এর মধ্যে কোনো ছেলেই মাকে দেখতে আসেননি।

অভিযোগের বিষয়ে মরিয়মের পঞ্চম ছেলে প্রথম আলোকে বলেন, সংসারে একসঙ্গে থাকলে রাগারাগি হতেই পারে। তবে নির্যাতনের বিষয়টি সত্য নয়। দুই ভাই মায়ের জন্য টাকা দেন। মাকে কবে আনবেন এবং দায়িত্ব কে নেবেন, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি তো একা সিদ্ধান্ত নিতে পারব না। সব ভাইয়েরা মিলে সিদ্ধান্ত নেবেন।’

তিনি মাকে নিয়ে নোংরা রাজনীতি শুরু করেছেন। আমরা সবাই প্রতিষ্ঠিত। বিগত সময়ের মতো সব সময়ই মাকে দেখাশোনা করার মতো সদিচ্ছা ও সামর্থ্য আমাদের রয়েছে।
মরিয়মের বড় ছেলে

মরিয়মের বড় ছেলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘অসুস্থ হওয়ার পর মাকে তাঁর সন্তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা উচিত ছিল। মা যে ভাইয়ের বাড়িতে থাকেন, সেখান থেকে মীনা মালেকের বাসার দূরত্ব মাত্র পাঁচ-ছয় মিনিটের। কিন্তু মীনা মালেক সেটি না করে গ্রামের সবাইকে নিয়ে মিটিং করে মায়ের সম্পত্তি বিক্রি করে মায়ের ভরণপোষণ এবং গ্রামে ভাইদের ঘরে তালা ঝুলিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যা সত্যি দুঃখজনক। তিনি মাকে নিয়ে নোংরা রাজনীতি শুরু করেছেন। আমরা সবাই প্রতিষ্ঠিত। বিগত সময়ের মতো সব সময়ই মাকে দেখাশোনা করার মতো সদিচ্ছা ও সামর্থ্য আমাদের রয়েছে।’

মীনা মালেক প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানবিক নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে আমি তাঁর সেবা করছি। তাঁর ছেলেদের জানানোর পর এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও তাঁরা মায়ের খোঁজ নেননি, যা আমাকে মর্মাহত করেছে। মাকে সন্তানের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার সব প্রচেষ্টাই চালানো হচ্ছে।’

ধামরাই উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা হোসাইন মোহাম্মদ হাই জকী প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি জানার পর ওনার ছেলেদের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। তাঁরা এ ব্যাপারে আন্তরিক নন। স্থানীয় পর্যায় থেকে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। সুস্থ হলে তিনি যৌক্তিক যে পদক্ষেপ নিতে চান, তাতে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে।