সংগ্রামী ঝুমুরের গল্প

রাজবাড়ীতে বাইসাইকেল চালিয়ে পত্রিকা বিলি করেন ঝুমুর দাস। প্রায় তিন বছর ধরে তিনি এই পেশায় নিয়োজিত। গতকাল সকালে শহরের রেলস্টেশন এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

রাজবাড়ী শহরের বড়পুল এলাকা। ভোরের আলো ফুটছে। এ সময় এক নারীকে বাইসাইকেল চালিয়ে এসে সেখানে থামতে দেখা গেল। জানা গেল, তাঁর নাম ঝুমুর দাস। পত্রিকার এজেন্ট তিনি। কাকডাকা ভোরে বড়পুল এলাকা থেকে দৈনিক পত্রিকা সংগ্রহ করে অন্য হকারদের মধ্যে বিলি করেন তিনি। তিনি নিজেও কয়েকটি এলাকায় পত্রিকা বিলি করেন।

ঝুমুর দাসের বাবার বাড়ি ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার আশাপুর গ্রামে। এসএসসি পাসের পর ২০০২ সালে তাঁর বিয়ে হয়। এরপর স্বামী জীবন দাসের সঙ্গে রাজবাড়ী শহরের কলেজপাড়ার রেলকলোনিতে সংসার পাতেন।

ঝুমুর জানালেন, পাঁচ বছর আগেও তাঁর জীবন এমন ছিল না। জীবন দাস দৈনিক পত্রিকার এজেন্ট ছিলেন। ভালোই চলছিল তাঁদের জীবন। কিন্তু ২০১৬ সালের দিকে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন জীবন। চিকিৎসকেরা জানান, জীবন দাস কিডনির জটিলতায় ভুগছেন। সঙ্গে ডায়াবেটিসও আছে। প্রথমে চিকিৎসার জন্য তাঁকে নেওয়া হয় ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং পরে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে।

জীবন দাসকে যখন চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেওয়া হয়, তখন ব্যবসা দেখাশোনার ভার পড়ে ছেলে অরণ্য দাসের কাঁধে। কিন্তু তখন অরণ্য আক্ষরিক অর্থেই শিশু। বয়স ১২ কি ১৩ বছর। এতে হিমশিম খেতে হচ্ছিল তাকে। তাই বাধ্য হয়ে স্বামীর ব্যবসার হাল ধরেন তিনি। শুরু হয় ঝুমুরের নতুন যাত্রা।

ঝুমুর বলেন, প্রথম দিকে ব্যবসা করা তাঁর জন্য বেশ কঠিনই ছিল। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, প্রতিদিন ভোরে তাঁকে যেতে হতো রেলকলোনি থেকে বড়পুল। প্রায় দুই কিলোমিটার পথ। কিন্তু ভোরে যানবাহন পাওয়া যেত না। আর হকারদের মধ্যে পত্রিকা বিলি করে বাকি পত্রিকা নিজে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিলি করাও ছিল বেশ কঠিন। এ কাজে তাঁকে সাহায্য করত ছেলে অরণ্য দাস। সাইকেল চালিয়ে দূরের বাড়িগুলোয় পত্রিকা বিলি করত অরণ্য। কিন্তু ছেলের পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছিল তাতে। এর মধ্যে স্বামী জীবন দাস মারা যান ২০১৮ সালে।

খুব সকালে পত্রিকার গাড়ি আসে। কিন্তু অনেক সময় সেখানে যেতে গাড়ি পাওয়া যেত না। তাই একপর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেন নিজেই সাইকেল চালাবেন। ছেলে অরণ্যের সাহায্যে বাড়ির পাশের ফাঁকা মাঠে সাইকেল চালানো শিখে ফেলেন তিনি। এরপর আর পায় কে ঝুমুরকে! প্রতিদিন সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। পত্রিকা বিক্রির কাজ সরে ফেরেন ঘরে।

প্রতিদিনকার অভিজ্ঞতা কেমন, এমন প্রশ্নের জবাবে ঝুমুর বলেন, ‘প্রথম যখন সাইকেল চালাতাম, তখন পেছন থেকে অনেকে অনেক কিছু বলত। কিন্তু এসব আমি গায়ে মাখতাম না।’ তিনি বলেন, স্বামী জীবন দাসের চিকিৎসার সময় কিছু ধারকর্জ হয়েছে। তারও বেশ খানিকটা শোধ করেছেন। এখন ছেলে দশম শ্রেণিতে পড়ে। তার পড়াশোনার খরচ দিয়েও কিছু টাকা জমে তাঁর।

জেলা মহিলা পরিষদের সভাপতি লাইলী নাহার বলেন, ‘ঝুমুর একটি ব্যতিক্রম কাজ করছেন। তাঁকে অনেক প্রতিবন্ধকতা পার করতে হয়েছে। তিনি অনেক সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁকে আমরা সম্মান করি।’