সংরক্ষণের উদ্যোগ নেই

প্রায় ৩০ একর জমির ওপর জমিদারবাড়িটির অবস্থান। প্রতিনিয়ত চুরি হয়ে যাচ্ছে মূল্যবান দরজা-জানালা, লোহার কারুকার্যখচিত প্রত্নসম্পদ।

অযত্ন–অবহেলায় পড়ে আছে সদরপুরের বাইশরশি জমিদারবাড়ি। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে রাজবাড়ির বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থাপনা
ছবি: প্রথম আলো

ফরিদপুর শহর থেকে ৩৪ ‍কিলোমিটার দূরে পুখরিয়া-সদরপুর সড়কের পাশে জেলার ঐতিহ্যবাহী বাইশরশি জমিদারবাড়িটির অবস্থান। ১৫৭ বছর আগে (১২৭০ বঙ্গাব্দে) এ বাড়ি নির্মাণ করা হয়। এখনো পাঁচটি শানবাঁধানো পুকুর, বিশাল বাগানবাড়ি ও ছোট–বড় ১৪টি কারুকার্যখচিত দালান জমিদারদের কালের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। তবে চুরি হয়ে যাচ্ছে মূল্যবান দরজা-জানালা, লোহার কারুকার্যখচিত প্রত্নসম্পদ। এর মধ্যেই ৩০ জমিদারবাড়ির অর্ধেকের বেশি জায়গা দখল হয়ে গেছে।

এ জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা রঘুরাম সাহা ছিলেন ব্যবসায়ী। জমিদারি প্রথা বাতিল হওয়ার পর জমিদার বংশের উত্তরপুরুষ সুকুমার রায় বাহাদুর ছাড়া সবাই কলকাতা চলে যান। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সুকুমার রায় আত্মহত্যা করেন। এরপর থেকেই বাড়িটি একরকম পরিত্যক্ত। পরিত্যক্ত এ বাড়ির প্রাঙ্গণে উপজেলা ভূমি অফিস ও ইউনিয়ন ভূমি অফিস করা হয়েছে। জমিদারবাড়িটির যে পাঁচটি পুকুর রয়েছে, সরকারি উদ্যোগে তা মাছ চাষের জন্য ইজারা দেওয়া হয়েছে।

জমিদার বংশের উত্তরাধিকার অমরেশ রায় চৌধুরী রাজশাহীতে বসবাস করছেন। তিনি দলিলপত্র ঘেঁটে ২২.০১ একর জমির মালিকানা চেয়ে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ ট্রাইব্যুনাল কোর্টে ২০১২ সালে মামলা করেন। মামলায় তাঁর পক্ষে রায় দেন আদালত। মামলায় হেরে গিয়ে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক বাদী হয়ে ভিপি আপিল ট্রাইব্যুনালে ২০১৫ সালে মামলা করেন। এ আপিল মামলায়ও অমরেশ রায় চৌধুরী জিতে ওই সম্পত্তির আইনগত মালিক হন।

আপিলে হেরে গিয়ে জেলা প্রশাসক ‘গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও সরকারি সম্পত্তি রক্ষা আইনে’ ওই জমি পুনরায় সরকারের তত্ত্বাবধানে নিয়ে আসার জন্য ২০১৮ সালে হাইকোর্টে রিট পিটিশন দাখিল করেন। জেলা প্রশাসন উল্লেখিত ২২.০১ একর জমির মধ্যে থেকে ১৬.৪৫ একর জমির বিষয়ে এই রিট পিটিশন করেছেন, যা বিচারাধীন। এই জমিতে জমিদারবাড়িটির মূল বাড়ি, পুকুর, মঠমন্দিরসহ অন্যান্য স্থাপনা রয়েছে।

এ বিষয়ে ফরিদুপরের সদরপুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পূরবী গোলদার বলেন, এটি ‘ক’ তালিকাভুক্ত অর্পিত সম্পত্তি। জমিদার বংশের উত্তরাধিকার দাবি করে অমরেশ রায় চৌধুরী ট্রাইব্যুনালে মামলা করে এ বাড়ির আইনগত বৈধতা পান। এটি বাইশরশি জমিদারদের শেষ নিদর্শন। এটি বেহাত হয়ে গেলে এই ঐতিহ্য বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এ বাড়ি দেখতে দূরদূরান্ত থেকে লোকজন আসেন। এলাকার ঐতিহ্য ও প্রত্নসম্পদ রক্ষার জন্য বাড়িটি সংরক্ষণ করা জরুরি।

জমিদারদের উত্তরসূরি হিসেবে মামলা করেছেন অমরেশ রায় চৌধুরী। এ ব্যাপারে তাঁর ছেলে অমিত রায় চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাড়িটি অবশ্যই একটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে এ সম্পত্তি সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি। চুরি করে বাড়িটির মূল্যবান সামগ্রী লুট করে নেওয়া হয়েছে। কাঠের আসবাবসহ দরজা-জানালা, ছাদের কাঠের সিলিং পর্যন্ত লুট হয়ে গেছে। কোনো সংস্কার করা হয়নি। আজ মামলা করে আমরা সম্পত্তি পেয়েছি। সরকার এখন পাল্টা মামলা করে তা আটকে রেখেছে।’

অমিত রায় চৌধুরী বলেন, বাড়ি নিয়ে কী করা হবে, সে বিষয়ে তাঁরা এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। তবে এলাকাবাসীর সঙ্গে আলাপ করে এ বিষয়ে ভালো কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। তাঁরাও চান এ বাড়ির ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে।

বর্তমানে প্রায় ৩০ একর জমির ওপর জমিদার বাড়িটির অবস্থান হলেও চারপাশের অনেক জমি দখল হয়ে গেছে। এখানে একটি পর্যটনকেন্দ্র স্থাপনের দাবি স্থানীয় লোকজনের। তাতে ঐতিহ্যবাহী জমিদারবাড়িটিও রক্ষা করা হবে, মানুষও ইতিহাস জানতে পারবে।