সংরক্ষণের উদ্যোগ নেই, ধসে পড়ছে শতবর্ষী ভবন

  • বাড়ির পাশের জমির কিছু অংশ এখনো বেদখলে। কিছু জমি ভূমি অফিস ইজারা দেয়।

  • মূল ভবনটি সম্প্রতি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ঝিনাইদহ জেলার মানচিত্র

ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলা শহরের শাপলা চত্বর এলাকায় গেলেই চোখে পড়বে শৈল্পিক কারুকার্যে নির্মিত শত বছরের পুরোনো একটি ভবন। দ্বিতল এই ভবনের স্থাপত্যশৈলী আর দৃষ্টিনন্দন নকশা পথিকের মনে ভরিয়ে দেবে ঠিকই, তবে একই সঙ্গে অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে থাকা এই ভবনের বর্তমান অবস্থা দেখে অনেকেই আফসোস করবেন।

কোটচাঁদপুর শহরের একসময়ের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ছিলেন তারিণী দত্ত। ব্যবসার প্রয়োজনে তিনি কোটচাঁদপুর শহরে আবাস গড়ে তুলেছিলেন। জানা যায়, উনিশ শতকের শুরুর দিকে তারিণী দত্ত দৃষ্টিনন্দন এই ভবন নির্মাণ করেছিলেন। তবে সময়ের ব্যবধানে সংরক্ষণের অভাবে ভবনটি এখন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ভেঙে পড়ার ভয়ে দখলদারেরা ভবন ছেড়ে চলে গেছেন। তবে ভবনের নিচতলায় এখনো উপজেলা বিএনপি আর উপজেলা যুবলীগের কার্যালয় রয়ে গেছে।

সম্প্রতি সরেজমিন দেখা গেছে, ভবনের ভেতরের কক্ষগুলোর জানালা ও জানালার শিকগুলো চুরি হয়ে গেছে। ভবনের ছাদের পলেস্তারা খুলে পড়তে শুরু করেছে। এ ছাড়া ভবনের বাইরের বারান্দার দেয়াল থেকে অনেক ইট খুলে পড়েছে।

ঝিনাইদহ শহর থেকে ২৮ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে কোটচাঁদপুর শহরের অবস্থান। কোটচাঁদপুরকে একসময় ব্যবসাকেন্দ্রিক শহর বলা হতো। গুড় আর পাট—এই দুই ফসল ঘিরে জমজমাট ছিল শহরের ব্যবসা। স্থানীয় বাসিন্দা আতাউর রহমান বলেন, কোটচাঁদপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রে তারিণী দত্তের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছিল। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেই তিনি বাসভবন গড়ে তোলেন। রাস্তার সঙ্গে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আর পেছনে বাসভবন। ভবনের দ্বিতীয় তলায় তারিণী দত্তের গদিঘর ছিল।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভবন এলাকায় আরও বেশ কিছু স্থাপনা ছিল। তবে ওই স্থাপনাগুলো এখন আর নেই। বাড়ির পাশের জমির কিছু অংশ এখনো বেদখলে। আবার কিছু জমি স্থানীয় ভূমি অফিস বার্ষিক ইজারা দেয়।

উপজেলা ভূমি অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তারিণী দত্তের দুই দাগে প্রায় ৬২ শতক জমি ছিল। এই জমিতে তিনি বাসভবন আর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ওই জমি বর্তমানে সরকারের অর্পিত সম্পত্তির (ভিপি) তালিকাভুক্ত।

ভেঙে পড়ার ভয়ে দখলদারেরা চলে গেছেন। তবে নিচতলায় উপজেলা বিএনপি আর উপজেলা যুবলীগের কার্যালয় রয়ে গেছে।

ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার মনিরুল হক বলেন, এই জমির কিছু অংশ বন্দোবস্ত দেওয়া আছে। আর মূল ভবনটি সম্প্রতি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে সেখানে এখন আর কেউ অবস্থান করেন না। তবে ঝুঁকির মধ্যেও কেউ অবস্থান করলে সেটা তাঁরা অবগত নন।

স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারিণী দত্তের ভবনটি কোটচাঁদপুর মানুষের কাছে একটি স্মৃতিময় ভবন। ১৯৭০ সালে এই ভবনে প্রথম কোটচাঁদপুর বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে বিদ্যালয়টি নিজস্ব জায়গায় স্থানান্তরিত হয়েছে। ১৯৭৩ সালে ভবনটি কোটচাঁদপুর কলেজের ছাত্রাবাস হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। নব্বই দশক পর্যন্ত এখানে ছাত্রাবাস ছিল। পরে ভবনটির চারপাশে থাকা স্থাপনাগুলো ভেঙে নষ্ট হতে শুরু করে। একপর্যায়ে মূল ভবনও ভেঙে পড়তে শুরু করেছে।

এই ভবনের সামনেই ব্যবসা করেন কোটচাঁদপুর পৌরসভার কাউন্সিলর রকিব উদ্দিন। তিনি বলেন, ১৯৬১ সালে তারিণী দত্ত পরিবার-পরিজন নিয়ে ভারতে চলে যান। এরপর সরকার তারিণী দত্তের জমি ভিপি তালিকাভুক্ত করে।

রকিব উদ্দিন বলেন, তিনিও তারিণী দত্তের জমির কিছু অংশ ভূমি অফিস থেকে ইজারা নিয়ে ব্যবসা করছেন। এই অংশে কোটচাঁদপুর মৌজার ৩২ শতক জমি রয়েছে। এর মধ্যে তিনি ২২০ বর্গফুট ইজারা নিয়েছেন। আরও অনেকেই ইজারা নিয়ে জায়গা ব্যবহার করছেন। তবে কেউ কেউ ইজারা ছাড়াই এখানে আছেন বলে তিনি দাবি করেন।

কোটচাঁদপুর পৌরসভার মেয়র মো. সেলিমুজ্জামান বলেন, তারিণী দত্তের ভবনটি একদিকে ভেঙে পড়ছে, অন্যদিকে দখল হয়ে যাচ্ছে। পুরো জায়গাটি দখলমুক্ত করে ভবনটি ঘিরে একটি দর্শনীয় স্থান গড়ে তোলা যেতে পারে। কোটচাঁদপুর শহরে যদি ২-১টি দেখার মতো ভবন থাকে, তাহলে এটি তার মধ্যে একটি। সরকারের ভবনটি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের আওতায় নিতে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন বলে আশ্বাস দেন।