সংসারে ভাত জোটে না, ইটভাটার কাজে গিয়ে লাশ হলো ১০ বছরের জাহিদুল

প্রতীকী ছবি

বাবা বাক্‌-শ্রবণপ্রতিবন্ধী ও মা মানসিক ভারসাম্যহীন। ভিক্ষাই সংসারটিতে জীবিকার একমাত্র পন্থা হলেও তাতে সবার দুমুঠো ভাত জোগাড় হয় না। উপায় না পেয়ে ১০ বছরের শিশু জাহিদুলই ধরতে চেয়েছিল সংসারের হাল। ১২ দিন আগে সাতক্ষীরার গ্রামের বাড়ি থেকে কুমিল্লায় ইটভাটার কাজ করতে যায়। কষ্টের কাজ ভালো না লাগায়, তা ছেড়ে দিয়ে বাড়ি আসতে চেয়েছিল সে। কিন্তু শ্রমিক সরদার ও ইটভাটার মালিক তাকে ছাড়েনি। অবশেষে আজ মঙ্গলবার ভোরে শিশুটি এলাকায় ফিরেছে লাশ হয়ে।

শিশুটির পুরো নাম জাহিদুল ইসলাম। গত সোমবার কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার ব্রাহ্মণপাড়া রামনগর গ্রামে এমএসডি ইটভাটায় মারা যায় সে। ওই ভাটাতেই কাজ নিয়েছিল সে। তবে কীভাবে জাহিদুলের মৃত্যু হলো, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ইটভাটা থেকে একেকবার একেক কারণ বলা হচ্ছে। জাহিদুলকে ইটভাটায় কাজ করতে নিয়ে যাওয়া শ্রমিক সরদার রবিউল ইসলামের ভাষ্য, সোমবার বিকেলে মাটি ভেজানোর কাজে ব্যবহৃত মোটরের তারে জড়িয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয় জাহিদুল। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।

তবে জাহিদুলের গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার জয়নগর গ্রামের বাসিন্দা আকবর আলী ও আবদুল হক বলেন, শ্রমিক সরদার রবিউল ইসলাম দুপুর ১২টার দিকে মুঠোফোনে কল করে জাহিদুলের মৃত্যুর সংবাদ দেন। এর আগে সকালের দিকে তিনিই ‘জাহিদুল অসুস্থ’ মুঠোফোনে খবর দিয়েছিলেন। তখন রবিউল তাঁদের জানিয়েছিলেন, সকালের দিকে জাহিদুল সেখানে মারামারি করে আহত হয়। তাঁরা আরও বলেন, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে জাহিদুলের মৃত্যু হয়েছে দাবি করা হলেও ইটভাটার কাজে যাওয়ার পর থেকেই শিশুটি কষ্টের কাজ থেকে নিষ্কৃতি পেতে বাড়ি ফিরতে তাগাদা দিয়ে আসছিল বলে তাঁরা জেনেছেন।

আমার বোন ও ভগ্নিপতি দুজনই প্রতিবন্ধী। ভিক্ষা করেও সংসার না চালাতে পারায় রবিউলের পরামর্শে একমাত্র ভাগনে জাহিদুলকে ইটের ভাটার কাজে পাঠানো হয়। জাহিদুল সোমবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কাজ করার সময়ে মোটরের তারে জড়িয়ে মারা যায় বলে আমাদের জানানো হয়েছে। তবে আমরা শুনেছি, কাজ করতে না পারায় তাকে নির্যাতন করা হয়েছে।
সফুরুন্নেছা বেগম, জাহিদুলের খালা

আজ ভোরে জাহিদুলের মরদেহ এলাকায় ফেরার পর তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। এদিকে কীভাবে সে মারা গেল, এসব তদন্ত না করেই স্থানীয় কাশিমাড়ী ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যানের মাধ্যমে এ ঘটনা এক লাখ টাকায় রফা হওয়ার অভিযোগে উঠেছে।

এ বিষয়ে কাশিমাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান আবদুর রউফ প্রথম আলোকে বলেন, শিশুটি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে কুমিল্লার একটি ইটের ভাটায় মারা যায়। বিষয়টি নিছক একটি দুর্ঘটনা নিশ্চিত হওয়ার পর স্থানীয় লোকজনের মধ্যস্থতায় নিহতের পরিবারকে শ্রমিক সরদার রবিউল ইসলাম ব্যক্তিগতভাবে এক লাখ টাকা দিয়েছেন।

স্থানীয় সূত্রে আরও জানা যায়, শ্যামনগর উপজেলার জয়নগর গ্রামের হামজা আলী ও মোমেনা বেগম দম্পতির একমাত্র ছেলে জাহিদুল। বাবা হামজা আলী বাক্‌ ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী হওয়ায় তিনি কোনো রোজগার করতে পারেন না। মা মোমেনা বেগম মানসিক ভারসাম্যহীন হলেও মূলত তাঁর ভিক্ষার টাকাতেই পরিবারে সবার দুমুঠো ভাত জোগাড় হয়। পরিবারটির দুর্দশা দেখে শ্রমিক সরদার রবিউল ইসলাম জাহিদুলকে কুমিল্লার রামনগর এলাকার ইটের ভাটায় নিয়ে কাজে দেন। ভাটায় নেওয়ার আগে জাহিদুলের পরিবারকে রবিউল অগ্রিম কিছু টাকাও দেন।

সোমবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে জাহিদুল বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে মারা যায় বলে আমাকে জানান এমএসডি ইটভাটার ম্যানেজার। করোনার কারণে স্কুল বন্ধ থাকা এবং পরিবারের কোনো আয়–রোজগার না থাকায় আমার প্রস্তাবে রাজি হয়েই জাহিদুলকে আমার সঙ্গে পাঠিয়েছিল তার পরিবার।
রবিউল ইসলাম, শ্রমিক সরদার

জাহিদুলের খালা সফুরুন্নেছা বেগম বলেন, তাঁর বোন ও ভগ্নিপতি দুজনই প্রতিবন্ধী। ভিক্ষা করেও সংসার না চালাতে পারায় রবিউলের পরামর্শে জাহিদুলকে ইটের ভাটার কাজে পাঠানো হয়। ভাগনে জাহিদুল সোমবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কাজ করার সময়ে মোটরের তারে জড়িয়ে মারা যায় বলে তাঁদের জানানো হয়েছে। তবে তাঁরা শুনেছেন, কাজ করতে না পারায় তাকে নির্যাতন করা হয়েছে।

এদিকে শ্রমিক সরদার রবিউল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কুমিল্লায় দুটি ভাটায় তাঁর শ্রমিক দেওয়া রয়েছে। সোমবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে জাহিদুল বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে মারা যায় বলে তাঁকে জানান এমএসডি ইটভাটার ম্যানেজার। রবিউল বলেন, ‘আমার নিজের ১২ বছর বয়সী ছেলে রাকিবও ইটভাটায় কাজ করছে। করোনার কারণে স্কুল বন্ধ থাকা এবং পরিবারের কোনো আয়–রোজগার না থাকায় আমার প্রস্তাবে রাজি হয়েই জাহিদুলকে আমার সঙ্গে পাঠিয়েছিল তার পরিবার।’

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে সংশ্লিষ্ট ইটভাটার ম্যানেজার মামুন কারিকর ও ভাটা কোম্পানির পরিচালক গিয়াসউদ্দীনের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তাঁরা কেউই ধরেননি।

শ্যামনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. নাজমুল হুদা বলেন, শিশুটির মৃত্যুর বিষয়ে কেউ কোনো অভিযোগ করেনি। তবে তিনি বিষয়টি খোঁজখবর নেবেন।

এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) শ্যামনগর উপজেলা শাখার সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম বলেন, ইটভাটায় শিশু শ্রমিকের ব্যবহার বন্ধে আইন থাকলেও তার প্রয়োগ নেই। এমন মর্মস্পর্শী ঘটনার দায় এড়াতে পারে না কোনো পক্ষ। জরুরি ভিত্তিতে শিশু জাহিদুলের মৃত্যুর ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নিয়ে ইটভাটায় শিশু শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ করার দাবি করেন তিনি।