‘সবজি না নাগাইলে খাইম কী, হামার পেকে তো কায়ও দেখে না’
রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার আলমপুর গ্রামের হারুন অর রশিদ এ বছর ৬০ শতক জমিতে সবজি লাগিয়েছিলেন। জমিতে চারা রোপণের পর সতেজ হয়ে উঠেছিল সবজির গাছ। কিন্তু বন্যায় জমে থাকা পানিতে তাঁর সবজিখেত নষ্ট হয়ে গেছে।
আজ শুক্রবার নষ্ট হওয়া পটোলের মাচা ঠিক করতে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায় হারুন অর রশিদকে। ‘চাচা, মাচা ঠিক করছেন, গাছ কোথায়?’ এমন প্রশ্ন করতেই কৃষক হারুন উত্তর দিলেন, ‘আল্লায় নিছে কী আর করার। বানোত সউগ সবজি শ্যাষ। ৪০ শতক জমির পটোল, ২০ শতক জমির করলাগাছ মরি গেইছে। ফের সবজি নাগার জন্য মাচা ঠিক করুছুং। কিন্তুক হাতোত টাকাপাইসা নাই। তোমরা আনা সবজির বীজের ব্যবস্থা করি দেন। সবজি না নাগাইলে মুই খাইম কী? হামার পেকে তো কায়ও দেখে না।’
জমিতে সবজির বীজ ছিটাচ্ছেন শেরমস্ত গ্রামের কৃষক আনিছুর রহমান। পেশায় তিনি একজন সবজিচাষি। সেপ্টেম্বর মাসের টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢল ভেঙে দিয়েছে তাঁর স্বপ্ন। কথা বলতে বলতে কাজ বন্ধ করে জমির আলে বসে পড়েন তিনি। সামনের দেড় একর জমি দেখিয়ে তিনি বলেন, বৃষ্টির পানিতে নষ্ট হয়ে যাওয়া সবজিখেতগুলো তাঁরই। প্রতিবারের মতো এবারও পটোল, লাউ, চিচিঙ্গা, কাঁকরোল, বরবটি, পুঁইশাক, লালশাক, লাউশাক, বেগুনসহ নানা জাতের শাকসবজি লাগিয়ে ছিলেন জমিতে। বন্যার পানিতে তা নষ্ট হয়ে গেছে। আবার সবজির বীজ ছিটাচ্ছেন।
আনিছুর রহমান বলেন, ‘সোবায় কয় কৃষোক নাকি দ্যাশের প্রাণ। সেই কৃষকের সবজির খেত মরি গেল। ধারদেনা করি ফির সবজি নাগাওছে। তা–ও কায়ও সাহায্য দেওছে না।’
আলমপুর ইউনিয়নের ক্ষতিগ্রস্ত অনেক কৃষকেই হারুন অর রশিদ ও আনিছুরের মতো বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তাঁরা আবার জমিতে সবজি লাগাচ্ছেন। স্থানীয় ব্যক্তিদের মতে, ওই ইউনিয়নের ৪০ ভাগ মানুষেই সবজি চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তাঁদের উৎপাদিত সবজি ঢাকার বাজারে পাইকারি দামে পাঠানো হয়। আবার কিছু পণ্য বিক্রি হয় স্থানীয় বাজারে।
বানিয়াপাড়ার মাঠে গাছবিহীন একটি লাউয়ের মাচার খুঁটি ঠিক করছিলেন ওই গ্রামের কৃষক ওহাব মিয়া (৪৫)। বন্যার পানি নেমে যাওয়ায় নতুন করে আবার চারা লাগাবেন, তাই মাচা ঠিক করা। তিনি জানালেন, দেড় একর জমির মাচায় লাউগাছ ছিল, বন্যায় মরে গেছে। এ ছাড়া ৬০ শতক জমির লালশাক, পুঁইশাক, করলা, কাঁকরোলসহ বিভিন্ন মৌসুমি সবজির বাগান নষ্ট হয়েছে বন্যায়। আবার সবজি লাগানোর জন্য মাচা ঠিক করছেন তিনি।
আজ শুক্রবার পুরো আলমপুর ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেছে, কলা, পটোল, লাউ, ফুলকপি, টমেটোসহ অন্যান্য শাকসবজির বাগান ও চারা বন্যায় বিনষ্ট হয়ে গেছে। এসব খেতে আবার ফসল লাগাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষিরা।
পারঘাট গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ময়েন উদ্দিন (৩৬) জানান, বন্যা তাঁদের সবকিছু ধ্বংস করেছে। গত বছরে তাঁদের যে ক্ষতি হয়েছে, তার থেকে অনেক বেশি ক্ষতি হয়েছে এবারের বন্যায়। সবজি নষ্ট হওয়ায় তাঁরা খুবই বেকায়দায় পড়েছেন। ধারদেনা করে আবার সবজি লাগাচ্ছেন তাঁরা।
আলমপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এনামুল হক বলেন, আলমপুর ইউনিয়নে শতকরা ৪০ ভাগ লোক সবজি চাষি। টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে তাঁদের সবজি নষ্ট হয়েছে। আবার সবজি লাগিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু সরকারিভাবে কোনো বরাদ্দ না পাওয়ায় এসব চাষিদের সহযোগিতা করতে পারছি না।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ঊর্মি তাবাস্সুম বলেন, তারাগঞ্জে বন্যায় ৮০ হেক্টর জমির সবজি নষ্ট হয়েছে। এতে কৃষকের প্রায় ১৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে।