সবার চিন্তায় কালুরঘাট সেতু

‘নির্বাচন এলেই কালুরঘাট সেতু নিয়ে প্রার্থীদের প্রতিশ্রুতির খই ফোটে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আদৌ এই সেতু হবে, তেমন কোনো আশা দেখি না। সেতুর আশ্বাস দিয়ে অনেকেই মন্ত্রী-এমপি হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু সেতু তো হয়নি।’

চট্টগ্রাম-৮ (চান্দগাঁও-বোয়ালখালী) আসনের উপনির্বাচন নিয়ে প্রত্যাশার কথা জানতে চাইলে গতকাল সোমবার দুপুরে এভাবে প্রতিক্রিয়া জানালেন দোকানি এনামুল হক। বোয়ালখালী উপজেলার পূর্ব কধুরখীলের বাসিন্দা এনামের চট্টগ্রাম নগরের মোহরায় দোকান রয়েছে। প্রতিদিন দুবার সেতু পার হওয়ার ভোগান্তি মাথায় নিয়ে তাঁকে দোকানে আসা-যাওয়া করতে হয়। 

এনামের মতো বোয়ালখালীর অনেকেরই সংশয় রয়েছে নতুন কালুরঘাট সেতু হওয়া নিয়ে। তবে সেতুর দাবি থেকে সরছেন না তাঁরা। গতকাল উপজেলার বিভিন্ন এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে এই দাবির কথা জানা যায়। তাঁদের ভাষ্য, গত ১০ বছরে উপজেলায় প্রত্যাশিত উন্নয়ন হয়নি।

সাংসদ মইন উদ্দীন খান বাদলের মৃত্যুতে আসনটি শূন্য হয়। ১৩ জানুয়ারি এখানে উপনির্বাচন। ছয়জন প্রার্থী থাকলেও মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে আওয়ামী লীগের মোছলেম উদ্দিন আহমদের সঙ্গে বিএনপির আবু সুফিয়ানের। পোস্টারে ছেয়ে গেলেও উপজেলায় এখনো নির্বাচনের আমেজ জমে ওঠেনি।

বারবার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গে ক্ষুব্ধ ভোটাররা

বরাবরের মতো এবারও নির্বাচনে মূল ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে কালুরঘাট সেতু। টানা তিনবারের সাংসদ মইন উদ্দীন খান বাদলেরও প্রধান প্রতিশ্রুতি ছিল সেতু নির্মাণের। একপর্যায়ে সেতু না হলে সংসদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি।

গতকাল সকাল সাড়ে ১০টা। উপজেলার বহদ্দারপাড়ার মোড়ে আড্ডা দিচ্ছিলেন তিন প্রবীণ—মোহাম্মদ হোসেন, নুরুল আলম ও মোহাম্মদ মহসিন। 

এলাকার বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে মাথাব্যথা না থাকলেও কালুরঘাট সেতু না হওয়ায় হতাশা ব্যক্ত করেন তাঁরা। অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক মোহাম্মদ মহসিন চুপ থাকলেও অন্য দুজন কালুরঘাট সেতু নিয়ে কথা বলেন। তাঁরা বলেন, ব্রিজটা (কালুরঘাট সেতু) তাঁদের জন্য দুর্ভাগ্যের হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেতু পার হতে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়িতে বসে থাকতে হয়। প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপি থাকার পরও সেতু না হওয়া বোয়ালখালীবাসীর জন্য চরম দুর্ভাগ্যের।

ফুলতল থেকে তিন কিলোমিটার দূরে সারোয়াতলীর অলিবেকারি এলাকা। বাজারে সেলুনের দোকানে কথা হয় দোকানি দুলাল বরণ শীল ও স্থানীয় অমিত কুমার নাথের সঙ্গে। তাঁরা বলেন, এই একটি সেতুর কারণে বোয়ালখালী আঁধার হয়ে আছে।

>চট্টগ্রাম-৮ আসনে উপনির্বাচন। সেতু না হওয়ায় হতাশ ভোটাররা। সেতুর আশ্বাস দিয়ে অনেকেই মন্ত্রী-এমপি হয়েছেন, কিন্তু সেতু হয়নি।

১৯৩০ সালে নির্মিত এই সেতুটি মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় ২০০১ সালে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে রেলওয়ে। বোয়ালখালী থেকে চট্টগ্রাম নগরে আসার প্রধান মাধ্যম হচ্ছে কালুরঘাট সেতু। প্রতিদিন প্রায় এক লাখ লোক ঝুঁকি ও ভোগান্তি নিয়ে এই সেতু দিয়ে চলাচল করেন।

গতকাল সরেজমিনে দেখা যায়, সেতুজুড়ে গর্ত আর গর্ত। এর মধ্যে চলাচল করছে বিভিন্ন ধরনের যানবাহন। সেতুর দুই দিকে গাড়ির সারি। এক দিক থেকে ছাড়া হলে অন্য দিক বন্ধ থাকে। ট্রেন এলে তখন দুই দিকে গাড়ি চলাচল বন্ধ রাখা হয়। মাঝেমধ্যে সেতুর মাঝপথে বিকল হয়ে পড়ে গাড়ি। তখন ভোগান্তি আরও বাড়ে।

সেতু নিয়ে দুর্ভোগের কথা জানিয়ে উপজেলার নতুন মসজিদ এলাকার বাসিন্দা শহীদুল আলম বলেন, একমুখী সেতুতে এক দিক থেকে গাড়ি চললে অন্য দিক বন্ধ থাকে। এ কারণে গ্রাম থেকে একজন রোগীকে শহরে নিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। 

চট্টগ্রাম-৮ আসনে বিএনপির প্রার্থী আবু সুফিয়ান প্রথম আলোকে বলেন, বোয়ালখালীর রাস্তাঘাটের অবস্থা খুব করুণ। উন্নয়নের গল্প শোনা যায়, কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় না। আর কালুরঘাট সেতু নির্বাচনী বৈতরণি পার হওয়ার অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

উন্নয়ন নিয়ে হতাশা 

উপজেলার প্রধান রাস্তা কানুনগোপাড়া সড়ক। সড়কে একটু পরপর গর্ত। সড়কের অনেক জায়গায় পিচ উঠে গেছে। ব্যস্ততম এই সড়কটি অনেকটাই সরু। মোড়ে মোড়ে গাড়ির জট লেগে থাকে। একই চিত্র দেখা যায় বেঙ্গুরা সড়কেও। 

উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো সংস্কার না হওয়ায় ত্যক্ত-বিরক্ত ব্যবসায়ী আবদুল আজিজ। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বছরের পর বছর ধরে সড়কগুলো বেহাল পড়ে আছে। সংস্কার বা সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেই। অথচ এসব সড়ক দিয়ে হাজারো মানুষ চলাচল করে। 

অবশ্য কানুনগোপাড়া সড়কে মুক্তিপাড়া অংশ সম্প্রসারণের কাজ চলতে দেখা যায়। এ কারণে সড়কে গাড়ির জট সৃষ্টি হয়। 

উপজেলা সদরের এক বাসিন্দা বলেন, পারিবারিক ও নানা কাজে চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। এসব উপজেলার তুলনায় বোয়ালখালীর তেমন উন্নয়ন হয়নি। তিনি বলেন, এই আসনের দুটি অংশ। একটি নগর ও অন্যটি বোয়ালখালী উপজেলা। নগরে সিটি করপোরেশন, সিডিএ কাজ করলেও উপজেলার উন্নয়নে তেমন কেউ তৎপর না। 

উপজেলা প্রকৌশল কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বোয়ালখালীতে ছোট-বড় ৩৫৪টি সড়ক রয়েছে। এর মোট দৈর্ঘ্য ৬৮৯ কিলোমিটার। এর মধ্যে পিচঢালা সড়ক রয়েছে ১৯৬ কিলোমিটার। অন্তত ৪৫ কিলোমিটার সড়কের অবস্থা ভালো নয়। 

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. ফারুক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, পর্যাপ্ত বরাদ্দ না থাকায় সড়ক সংস্কার করা যাচ্ছে না। 

দলীয় সরকার থাকার পরও বোয়ালখালীতে প্রত্যাশিত উন্নয়ন হয়নি বলে স্বীকার করেছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোহাম্মদ মোকারম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, উন্নয়নকাজের জন্য মন্ত্রণালয়গুলোতে অনেক দৌড়ঝাঁপ করতে হয়। কিন্তু আগের সাংসদের মধ্যে সেই তৎপরতা না থাকায় অন্যান্য উপজেলার তুলনায় বোয়ালখালী পিছিয়ে পড়েছে। তবে এবার তাঁদের প্রার্থী নির্বাচিত হলে সেই অবস্থার পরিবর্তন হবে।