সবার প্রিয় 'আর কে' স্যার...
রাস্তার দুই পাশে সারিবদ্ধভাবে বসে আছেন শতাধিক শিক্ষার্থী। কেউ কেউ প্ল্যাকার্ড লিখছেন, কেউ বা রাস্তায় আঁকছেন আলপনা। একজন শিক্ষার্থী সবার উদ্দেশে স্লোগানের সুরে প্রশ্ন করছেন, ‘খেলার মাঠে আমাদের উৎসাহ দিতেন কে?’ সমস্বরে উত্তর, ‘আর কে স্যার।’ পরের প্রশ্ন, ‘ক্লাসে সিনেমা নিয়ে গল্প করতেন কোনো স্যার?’ সবার উত্তর, ‘সবার প্রিয় আর কে স্যার।’ আবার প্রশ্ন, ‘পড়াশোনায় উদ্বুদ্ধ করতেন কে?’ এটারও উত্তর একই।
আজ রোববার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোডে গিয়ে দেখা গেল এমন দৃশ্য। সবার প্রিয় এই ‘আর কে’ স্যার হলেন ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকী। শিক্ষার্থীদের কাছে যিনি ‘আর কে স্যার’ হিসেবেই বেশি পরিচিত ও আপন।
গতকাল শনিবার সকালে রাজশাহী নগরের শালবাগান এলাকায় দুর্বৃত্তরা হত্যা করে ইংরেজি বিভাগের জনপ্রিয় এই শিক্ষককে। প্রিয় শিক্ষকের হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে আজ দুপুর ১২টা থেকে বেলা দেড়টা পর্যন্ত প্যারিস রোডে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন ওই বিভাগের শিক্ষার্থীরা।
অবস্থান কর্মসূচিতে এক শিক্ষার্থী স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগে ইংরেজি পড়ার অভ্যাস ছিল না। ক্লাসে সবার পেছনে বসতাম। তাই স্যারদের লেকচার বুঝতে অসুবিধা হতো। একমাত্র আর কে স্যারই শিক্ষার্থীদের সুবিধার্থে বাংলায় ক্লাস নিতেন। সবার শুনতে যাতে সুবিধা হয়, এ জন্য ক্লাসের ফ্যান বন্ধ রাখতেন।’ অপর শিক্ষার্থী বলেন, ‘মুক্তমঞ্চে প্রথম যেদিন গান গাইতে উঠি, তখন খুব ভয় হচ্ছিল। কিন্তু যখন দর্শকসারিতে দেখলাম স্যার আমার গান শুনতে এসেছেন, তখন সব ভয় দূর হয়ে গেল।’
অবস্থান কর্মসূচিতে বক্তব্য দেন ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী কানন, স্বাক্ষর, অণিমা, জান্নাত, সংগীতা, অথৈ, সালিম, আসিফ প্রমুখ। শিক্ষার্থীরা জানালেন, স্যার (এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকী) এমন এক শিক্ষক ছিলেন, যিনি ক্লাসে অ্যাটেনডেন্স (উপস্থিতি) নিতেন না। বলতেন, ‘তোমাদের এথিকসে (নৈতিকতা) যদি আসে, তোমরা যদি আমার কাছ থেকে কিছু শিখতে চাও, তাহলে আমার ক্লাস করবে। শুধু অ্যাটেনডেন্স দেওয়ার জন্য নয়।’ শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘বিভিন্ন জায়গায় স্যারকে নাস্তিক, ব্লগার বলে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। স্যারের কোনো ব্লগ-ই ছিল না। তিনি নাস্তিকও ছিলেন না। আর স্যার কী ছিলেন, সেটা জানানোর জন্য আমরা এখানে আসিনি। আমরা এসেছি স্যারের হত্যাকারীদের বিচার চাইতে।’
অধ্যাপক রেজাউল করিমের সহকর্মী বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, অধ্যাপক রেজাউল করিম শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রচণ্ড জনপ্রিয় একজন শিক্ষক ছিলেন। নিয়মিত ক্লাস নেওয়া, সাংস্কৃতিক চর্চা করা, খেলার মাঠে যাওয়া, বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা করাই ছিল তাঁর কাজ। শিক্ষার্থীদের মধ্যে অধ্যাপক রেজাউল করিমের জনপ্রিয়তা নিয়ে দ্বিমত নেই কারও।
অধ্যাপক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকী হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে আজ সকাল থেকে ক্যাম্পাসে সব ধরনের ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে মিছিল, প্রতিবাদ সমাবেশ, মৌন মিছিল, মানববন্ধন করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
বেলা ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনের সামনে থেকে মৌন মিছিল বের করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। মিছিলটি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক ঘুরে আবার সিনেট ভবনের সামনে গিয়ে শেষ হয়। হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে পরে সেখানে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
এদিকে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক শাহ আজম শান্তনু বলেন, ‘আমরা আমাদের সহকর্মী রেজাউল স্যারের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সোমবার পর্যন্ত সব ধরনের ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
আরও পড়ুন