সমতলের চায়ে সম্ভাবনার হাতছানি

দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের সমতল ভূমিতে চা চাষ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের পর তৃতীয় বৃহত্তম চা–অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে পঞ্চগড়। পঞ্চগড়কে অনুসরণ করে চা চাষে এগিয়ে যাচ্ছে পার্শ্ববর্তী ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী ও লালমনিরহাট।

চা–বাগানের মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রথম দিকে টবে, কলেজের মাঠে, পরে পতিত জমিতে চা চাষ করা হয়। সেই সফলতা থেকেই বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বাড়তে থাকে চা চাষের পরিধি। প্রথম দিকে ক্ষুদ্র পর্যায়ে শুরু হলেও ২০০০ সালে তেঁতুলিয়া টি কোম্পানি এবং পরে কাজী অ্যান্ড কাজী টি স্টেটসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানি বাগানপর্যায়ে চা চাষ শুরু করে। এরপর ক্ষুদ্র চাষি পর্যায়েও ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে চা চাষের পরিধি। জেলার সমতল ভূমিতে চা চাষ শুরুর পর ২০০৭ সালে ঠাকুরগাঁও ও লালমনিরহাট এবং ২০১৪ সালে দিনাজপুর ও নীলফামারী জেলায় চা চাষ শুরু হয়। ৫টি জেলায় বর্তমানে নিবন্ধিত ১০টি ও অনিবন্ধিত ১৭টি বড় চা–বাগান (২৫ একরের ওপরে) রয়েছে। এ ছাড়া ১ হাজার ৫১০টি নিবন্ধিত ও ৫ হাজার ৮০০টি অনিবন্ধিত ক্ষুদ্রায়তন চা–বাগানে (২৫ একর পর্যন্ত) রয়েছে। এ পর্যন্ত ১০ হাজার ১৭০ দশমিক ৫৭ একর জমিতে চা চাষ সম্প্রসারণ করা হয়েছে। এমনকি বসতভিটায়ও বিস্তৃত হয়েছে চা চাষ। তবে পঞ্চগড়ে প্রায় ৪০ হাজার একর জমি চা চাষের উপযুক্ত বলে বলছে বাংলাদেশ চা বোর্ড।

চা–বাগানে পাতা সংগ্রহ করছেন কয়েকজন শ্রমিকে। গতকাল সকালে পঞ্চগড় সদর উপজেলার অমরখানা ইউনিয়নে ।
ছবি: প্রথম আলো

চা চাষ সম্প্রসারণ ও চা–শিল্পের উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০০১ সালে বাংলাদেশ চা বোর্ডের প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের একটি উপকেন্দ্র পঞ্চগড়ে স্থাপিত হয়। পরবর্তীকালে যা বাংলাদেশ চা বোর্ড আঞ্চলিক কার্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। পরে উত্তরাঞ্চলে চা চাষ সম্প্রসারণ এবং চায়ের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ চা বোর্ড ‘নর্দান বাংলাদেশ প্রকল্প’ হাতে নেয়, যা ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত চলবে। এ প্রকল্পে প্রথমে ৪ কোটি ৯৭ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও পরে তা বাড়িয়ে ৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা করা হয়।

চা বোর্ড আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, উত্তরাঞ্চলে চা চাষের ওপর ভিত্তি করে এ পর্যন্ত ৩৩টি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা অনুমোদন নিয়েছে। এর মধ্যে পঞ্চগড় জেলায় ১৭টি ও ঠাকুরগাঁও জেলায় ১টি কারখানা চালু রয়েছে। এই কারখানাগুলো চাষিদের কাছ থেকে সবুজ পাতা কিনে তা থেকে চা তৈরি করে। এই চা নিলাম বাজারে বিক্রি করেন চা প্রক্রিয়াকরণ কারখানার মালিকেরা। গত মৌসুমে একেকটি কারখানা সর্বোচ্চ ২৫ লাখ কেজি পর্যন্ত তৈরি চা উৎপাদন করেছে।

পঞ্চগড়ের চা চাষ বিস্তৃত হয়েছে বসতভিটাতেও । গতকাল দুপুরে সদর উপজেলার অমরখানা ইউনিয়নের মহারাজার দিঘী এলাকার একটি বাড়িতে।
ছবি: প্রথম আলো

২০১৮ সালে উত্তরাঞ্চলে সবুজ চা পাতা উৎপাদন করা হয়েছে ৪ কোটি ১৬ লাখ ২৮ হাজার ৯৮১ কেজি এবং তা থেকে তৈরি চা উৎপাদিত হয়েছে ৮৪ লাখ ৬৭ হাজার কেজি। ২০২০ সালে সবুজ চা–পাতা (কাঁচা) উৎপাদিত হয়েছে ৫ কোটি ১২ লাখ ৮৩ হাজার ৩৮৬ কেজি এবং তা থেকে তৈরি চা উৎপাদিত হয়েছে ১ কোটি ৩ লাখ কেজি। গত মৌসুমে তৈরি চায়ের জাতীয় উৎপাদন হয়েছে ৮৬ দশমিক ৩৯ মিলিয়ন কেজি। এর মধ্যে উত্তরাঞ্চলের ৫টি জেলা—পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী ও লালমনিরহাটের সমতল ভূমিতেই উৎপাদিত হয়েছে ১ কোটি ৩ লাখ কেজি, অর্থাৎ ১০ দশমিক ৩০ মিলিয়ন কেজি; যা গত মৌসুমের চেয়ে ৭ দশমিক ১১ লাখ কেজি বেশি। এবার জাতীয় উৎপাদনের ১১ দশমিক ৯২ শতাংশ চা যুক্ত হয়েছে উত্তরাঞ্চলের সমতল ভূমি থেকে।

উত্তরাঞ্চলের চা–শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে মানুষের কর্মসংস্থান। চা বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী উত্তরাঞ্চলে চা–বাগান, প্রক্রিয়াকরণ কারখানা ও প্যাকেটজাতকরণ ছোট ছোট কারখানাগুলোতে প্রায় ২৫ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। তাঁদের প্রায় অর্ধেকই নারী। চা–বাগান ও কারখানাগুলোতে কাজ পেয়ে এখন অনেকেরই জীবনযাত্রার মান পরিবর্তন হয়েছে। চা–শিল্প থেকে প্রতিবছর সরকারের মোটা অঙ্কের রাজস্ব আদায় হচ্ছে। ২০১৯ সালে উত্তরাঞ্চলে ৯৬ লাখ কেজি তৈরি চা উৎপাদিত হয়েছিল। ওই সময় তৈরি চায়ের দাম বেশি থাকায় উৎপাদিত তৈরি চা বিক্রি হয়েছিল প্রায় ২০০ কোটি টাকায়, যা থেকে সরকারের ১৫ শতাংশ হারে রাজস্ব আদায় হয়েছে প্রায় ৩০ কেটি টাকা। এরপর ২০২০ সালে এক কোটি তিন লাখ কেজি তৈরি চা উৎপাদিত হয়েছিল, যা বিক্রি হয়েছে প্রায় ১৫৬ কোটি টাকায়, যা থেকে সরকারের রাজস্ব আদায় হয়েছে প্রায় ২৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা।

বাংলাদেশ চা বোর্ড পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও নর্দান বাংলাদেশ প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ শামীম আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সমতল ভূমিতে চা চাষের জন্য পঞ্চগড় ও এর পার্শ্ববর্তী জেলাগুলো অত্যন্ত সম্ভাবনাময় এলাকা। চায়ের চাষ সম্প্রসারণের জন্য আমরা চাষিদের বিভিন্ন সহায়তার মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করছি। এ এলাকায় চায়ের নিলাম বাজার স্থাপনে সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে।’