সমতলের নৃগোষ্ঠীর মানুষেরা অস্থিরতায়, পাহাড় অশান্ত: সন্তু লারমা
মহান ভাষা আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতিচিহ্ন বহন করছে রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। এর পাদদেশেই আজ অনুষ্ঠিত হলো ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসের’ কেন্দ্রীয় আয়োজন। দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ‘ভাষাকেন্দ্রিক, আদিবাসী ভাষাচর্চা ও সংরক্ষণ’। তবে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের ভাষা ও সম্পদ সুরক্ষিত নয়, এ কথা উচ্চারিত হলো অনুষ্ঠানের সভাপতি পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় সন্তু লারমা। তিনি বললেন, সমতলে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষেরা অস্থিরতার মধ্যে আছে। আর পার্বত্য চট্টগ্রামে এক অশান্ত পরিবেশ বিরাজ করছে।
ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের ভবিতব্য কী, তা অজানা। এসব জাতিগোষ্ঠীর মানুষের আন্দোলনের পথিকৃৎ এই নেতা সন্তু লারমা বললেন, ‘বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের জীবনে কোন বাস্তবতা অপেক্ষা করছে, তা জানি না।’
আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস ৯ আগস্ট। এর কদিন পরেই এবার ঈদুল আজহা। তাই এ বছর দিবসটির কেন্দ্রীয় আয়োজন অনুষ্ঠিত হলো চার দিন আগেই। আজকের দিনটিতে উপস্থিতি ছিল কিছু কম। তবে আনুষ্ঠানিতকতার ঘাটতি ছিল না। বরাবরের মতো নিজ নিজ জাতিগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে নানা বয়সী নারী-পুরুষ এসেছিলেন শহীদ মিনারের এ আয়োজনে। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ছাত্র, যুব ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা ব্যানার ও প্লাকার্ড নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। সেখানে নৃগোষ্ঠীর মানুষের সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি ছিল, ছিল তাদের ভূমি-ভাষা-সম্পদের সুরক্ষা দাবি। সেই দাবি উচ্চারিত হলো সন্তু লারমার মুখেও। তিনি অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক শক্তির একতা চাইলেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি সন্তু লারমা বললেন, সাম্প্রদায়িকতা, জাতি-বিদ্বেষ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের জীবনকে গ্রাস করে ফেলছে।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানের মুখেও শোনা গেল ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের নিরাপত্তাহীনতার কথা। তিনি বললেন, পাহাড়ে কী সমতলে, নৃগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে সার্বক্ষণিক ভীতির আবহ বিরাজ করছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বাস্তবায়ন অনেকাংশে হলেও এর পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি। এ চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন না হলে পাহাড়ে শান্তি আসবে না।
মিজানুর রহমান বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন নিরাপত্তার জন্য হুমকি—এমনটাই শাসক চক্রকে বুঝিয়েছে আমলাতন্ত্র। এ ধারণা অমূলক, বিভ্রান্তিকর, অযৌক্তিক। তবে এখন বাংলাদেশে আর কোনো যুক্তি খাটে না।
পার্বত্য চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়ন না করার প্রসঙ্গ উঠে আসে আজকের অনুষ্ঠানের অন্যতম আলোচক সাবেক মন্ত্রী ও ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের বক্তব্যে। তিনি বলেন, ২৫ বছরের সংঘাতের পর পার্বত্য চুক্তি শেখ হাসিনার দূরদর্শিতার নিদর্শন। কিন্তু এর পূর্ণ বাস্তবায়ন না হওয়াটা লজ্জার বিষয়।
মেনন বলেন, ‘সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান চর থেকে নদীভাঙা মানুষকে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসিত করেছিলেন। এইচ এম এরশাদের সময় এ ধারাবাহিকতা ছিল। এরা এসব মানুষকে পাহাড়িদের বিরুদ্ধে সংঘাতে ঠেলে দিয়েছে। তবে আজও পার্বত্য চট্টগ্রামে জিয়া ও এরশাদের দৃষ্টিভঙ্গিই বলবৎ আছে।’
‘আদিবাসী দিবস’ জাতীয়ভাবে পালন না করার জন্য সমালোচনা করেন মেনন। তিনি বলেন, ‘এখন দিনটি পালনে নানা বাধা আসে। ফোন করে, সার্কুলার দিয়ে দিবস পালনে বাধা দেওয়া হয়।’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ছিল এটাই যে, কোনো জাতি অন্য জাতির ওপর শোষণ করবে না, নিপীড়ন করবে না। কিন্তু সেই আদর্শ আজ বিচ্যুত। আমরা এখন নৃগোষ্ঠীর মানুষের অধিকার নতুন করে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি। শোষণ আজও চলছে।’
আজ দিনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় জাতীয় সংগীত দিয়ে। ছিল নৃগোষ্ঠীর তরুণদের ব্যান্ড ‘মাদল’-এর পরিবেশনা। এরপর বেলুন উড়িয়ে দিবসের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে স্বাগত বক্তব্য দেন আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং। তিনি বলেন, ‘এ দিবসে আমরা অধিকারের কথা বলি। মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার কথা বলি।’
সঞ্জীব দ্রং বলেন, একটি রাষ্ট্রের রাজা-বাদশাহরা কতটা ভালো আছে তা দিয়ে কোনো দেশের অবস্থা বিবেচিত হয়। সেই দেশটিই সত্যিকারের গণতান্ত্রিক, যেখানে প্রান্তিক মানুষেরা ভালো থাকে, নিরাপদে থাকে।
আজ আরও বক্তব্য দেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডালেম চন্দ্র বর্মন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন সাদেকা হালিম প্রমুখ।