সরাইলের ঐতিহ্য গ্রে-হাউন্ড কুকুর বিলুপ্তির পথে

ব্রা‏‏হ্মণবাড়িয়ার সরাইলের নামকরা গ্রে-হাউন্ড কুকুর। বুধবার উপজেলার নোয়াগাঁও ইউনিয়নের চৌরাগোদা গ্রামে তপন রবি দাসের বাড়িতে
প্রথম আলো

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলায় গ্রে-হাউন্ড কুকুর বেশ নামকরা। এই জাতের কুকুর পোষা শৌখিনতা ও আভিজাত্যের পরিচয় বহন করে, যা লালন-পালন যথেষ্ট ব্যয়বহুল। সরাইলের ঐতিহ্য হিসেবেও পরিচিত গ্রে-হাউন্ড। তবে এ ধরনের কুকুর পালন অনেক কমে গেছে।

দুই দশক আগেও সরাইলের পাড়া-মহল্লায় অনেক বাড়িতে গ্রে-হাউন্ড কুকুর পুষতে দেখা যেত। শিকারি গোছের এই কুকুর বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেখা যায়। এর দেহ তিন থেকে চার ফুট লম্বা। কান ও মুখ বেশ লম্বাটে। পেট ছোট হলেও বুকটা চওড়া। লেজটা চিকন ও লম্বা। লেজটি অধিকাংশ সময় দেহের নিচের দিকে সোজা ঝুলে থাকে। খুব একটা বাঁকা করে না। হালকা–পাতলা গড়নের এই কুকুরের পা ও পায়ের নখ লম্বা। বাদামি রঙের চোখ দুটি বড় বড়।

শুধু আকৃতি বা দৈহিক গঠনের দিক থেকে গ্রে-হাউন্ড অন্যান্য কুকুরের চেয়ে আলাদা তা নয়। আচরণের দিক থেকেও আলাদা। হাঁটাচলা বা দৌড় দেওয়ার ভঙ্গিট ভিন্ন। ঘুমের অভ্যাসের মধ্যেও আছে ভিন্নতা। শুধু ঘ্রাণশক্তি নয়, দৃষ্টি ও শ্রবণশক্তির মাধ্যমে শিকার ধরা এদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। দ্রুতগামী কুকুরটি অন্যান্য কুকুরের মতো আহ্লাদী হলেও অপরিচিতদের আদর তার পছন্দ নয়। দিনেরবেলা ঘেউ ঘেউ করা তার স্বভাব না হলেও রাতের ঘেউ ঘেউ শব্দে অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি প্রভুর বাড়ির ত্রিসীমানায় আসতে পারে না। প্রভুভক্ত শান্ত কুকুরটি শত্রুর জন্য খুবই হিংস্র ও ভয়ংকর। দিনে-রাতে মালিকের বাড়ি নিরাপত্তায় জুড়ি মেলা ভার। চোর, ডাকাত এ কুকুরের নাম শুনলে আঁতকে ওঠে।

আরামপ্রিয় কুকুরগুলো প্রতিদিন অল্প পরিমাণ খেলেও তাদের খুব ভালো মানের খাবার দিতে হয়। প্রায় ৭০ কিলোমিটার গতি সম্পন্ন কুকুরটির খাদ্যতালিকায় আছে দুধ-ভাত ও মাংস। এদের জীবনকাল এক যুগ হয়ে থাকে।

বুধবার সরাইলের কলীকচ্ছ ইউনিয়নের মনিরবাগ গ্রামের উজ্জ্বল মিয়ার বাড়িতে তোলা
প্রথম আলো

একসময় শীতকালে এখানে গ্রে-হাউন্ড কুকুর দিয়ে বনজঙ্গল ঘেরাও করে ছোট বাঘ, গাছি খাটাশ, শিয়াল, বাগডাশ, বন খাটাশ, বনবিড়াল ইত্যাদি বন্য প্রাণী শিকার করা হতো। এই শিকার অভিযানের আনন্দও ছিল সীমাহীন। স্থানীয় প্রশাসন ও এলাকাবাসীর উদ্যোগে প্রতিবছর কুকুরের প্রদর্শনী হতো। তাতে কুকুরের গুণগত মান যাচাই করে পুরস্কার দেওয়া হতো। তখন অনেক শৌখিন ব্যক্তি গ্রে-হাউন্ড কুকুরের বাচ্চা কেনার জন্য গাড়ি হাঁকিয়ে সরাইলে আসতেন। একসময় জাতীয় চিড়িয়াখানায়ও দেখা যেত গ্রে-হাউন্ড কুকুর। কিন্তু কালের আবর্তে আজ সবই অতীত। তবে কয়েক বছর আগে র‌্যাব সদস্যরা বেশ কয়েকটি হাউন্ড কুকুর এখান থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। এ ব্যাপারে পরে আর কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

উন্নত বিশ্বে দিন দিন বিরল প্রজাতির কুকুরের কদর বাড়লেও সরাইলের ঐতিহ্য গ্রে-হাউন্ড কুকুর এখন বিলুপ্তির পথে। সরাইলের হাউন্ড কুকুর এখন এক দুর্লভ হয়ে গেছে। এখন হাতে গোনা কয়েকটি পরিবার এই জাতের কুকুর লালন-পালন করে আসছে। কারণ, এ ধরনের কুকুর পোষা অত্যন্ত ব্যয়বহুল।

গ্রে-হাউন্ড কুকুর নিয়ে জনশ্রুতি

সরাইলের গ্রে-হাউন্ড কুকুর নিয়ে বেশ কিছু জনশ্রুতি স্থানীয়দের কাছে প্রচলিত আছে। কথিত আছে, একবার সরাইলের জমিদার দেওয়ান হাতি নিয়ে কলকাতা যাচ্ছিলেন। পথে এক ইংরেজ সাহেবের কাছে একটি সুন্দর কুকুর দেখতে পান। তিনি কুকুরটি কেনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পরে তিনি একটি হাতির বিনিময়ে ইংরেজ সাহেব থেকে ওই কুকুরটি (মাদি-স্ত্রী জাতের) নিয়ে আসেন।

দেওয়ান একদিন হাতির পিঠে চড়ে বনে শিকারে বের হয়েছিলেন। একপর্যায়ে মাদি কুকুরটি বনে হারিয়ে যায়। বেশ কিছুদিন পর গর্ভবতী হয়ে কুকুরটি ফিরে আসে। কদিন পরই দেওয়ানের বাড়িতে কুকুরটি কয়েকটি বাচ্চা দেয়। দেখা গেল, এসব বাচ্চা সাধারণ কুকুরের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাচ্চাগুলোর সঙ্গে বাঘের বেশ মিল আছে। ধারণা করা হয়, নেকড়ের সঙ্গে দেওয়ানের কুকুরের মিলন থেকে ওই বাচ্চাগুলোর জন্ম হয়েছে।
বর্তমান অবস্থা

সম্প্রতি উপজেলার নোয়াগাঁও ইউনিয়নের চৌরাগোদা গ্রামে দাস পরিবারে গিয়ে ৭–৮টি গ্রে-হাউন্ড কুকুরের দেখা পাওয়া গেছে। মালিক এদের লায়ন-১, লায়ন-২, কালি (মাদি), লালি (মাদি), সুমি, আউশি নানা নামে ডাকেন। তবে শিকলে বাঁধা লাইন নামের দুটি কুকুর নতুন অতিথি দেখে বেশ উত্তেজিত হচ্ছিল। সব কটি কুকুরকে উন্নত গ্রে-হাউন্ড কুকুর মনে না হলেও দুই লায়ন আর ছোট্ট দুটি ছানাকে ঠিকই মনে হয়েছে প্রকৃত গ্রে-হাউন্ড কুকুর।

এগুলোকে রক্ষার উদ্যোগ নিলে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পাবে সরাইলের ঐতিহ্য গ্রে-হাউন্ড কুকুর।
জাহাঙ্গীর আলম, সরাইল উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা
তপন রবি দাসের বাড়িতে গ্রে-হাউন্ড কুকুর। বুধবার উপজেলার নোয়াগাঁও ইউনিয়নের চৌরাগোদা গ্রামে
প্রথম আলো

দাস বাড়িতে কথা হয় মোহনলাল রবি দাসের ছেলে তপন লাল রবি দাসের (৩৮) সঙ্গে। তিনি বলেন, শতাধিক বছর আগে সরাইল পরগনার তৎকালীন জমিদার দেওয়ান মনোয়ার আলী ওরফে মন্নর আলীর সঙ্গে তাঁর দাদা গঙ্গাচরণ রবি দাস ও দাদার বাবা কালীচরণ রবি দাসের সুসম্পর্ক ছিল। তাঁরা তখন উপজেলা সদরের বাসিন্দা ছিলেন। পরে দেওয়ান পরিবারের সহায়তায় কালীচরণ রবি দাসের একমাত্র ছেলে গঙ্গাচরণ রবি দাসকে নিয়ে চৌরাগোদা গ্রামের নির্জন এলাকায় বসতি স্থাপন করেন।

তপন লাল রবি দাস আরও বলেন, ‘দেওয়ান মন্নর আলী আমার দাদারে খুব আদর-স্নেহ করত। তিনিই ফথম (প্রথম) দুটি কুকুর দান করেন। সেই থেইক্কা আমরা কুকুর পালন ও বিক্রি কইরা আইতাছি।’ তিনি জানান, এক মাসের একটি বাচ্চা বর্তমানে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। পূর্ণ বয়স্ক (দেড়-দুই বছর) একটি কুকুর বিক্রি হয় অর্ধলক্ষাধিক টাকায়।

কুকুরের ছবি নিতে গেলে কিছুটা অনীহা প্রকাশ করেন তপন লাল রবি দাস। তাঁর ভাষ্য, অনেকেই কুকুরের ছবি নিয়ে যায়। পরে তাঁদের ক্ষতি করে। আবার স্থানীয় অনেকেই তাঁদের নাম পরিচয় দিয়ে রাস্তা থেকে দেশীয় জাতের কুকুর ধরে নিয়ে গ্রে–হাউন্ড বলে লোকজনের কাছে বিক্রি করে দেয়। এতে ক্রেতারা বিভ্রান্ত হন। এলাকার সুনাম নষ্ট হচ্ছে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এলাকার অনেক জনপ্রতিনিধি (এমপি-মন্ত্রী) যুগ যুগ ধরে কথা দিছে। গ্রে-হাউন্ড কুকুরের জন্য একটা কিছু করবেন, কিন্তু কেউ কথা রাখেনি। আমরা অতিকষ্টে এখনো এই জাতটা লালন–পালন কইরা আতাছি।’

শিকলে বাঁধা গ্রে-হাউন্ড কুকুর। বুধবার সরাইলের চৌরাগোদা গ্রামে তপন রবি দাসের বাড়িতে
প্রথম আলো

অন্যান্য গ্রামে গ্রে-হাউন্ড কুকুরের অবস্থা

চৌরাগোদা গ্রামের গঙ্গাচরণ রবি দাসের উত্তরসূরিরা বাণিজ্যিক দিক চিন্তা করে গ্রে-হাউন্ড কুকুর পালন করলেও উপজেলা সদরের কুট্টাপাড়া গ্রামের রমজান আলী, কালীকচ্ছ ইউনিয়নের মনিরবাগ গ্রামের উজ্জ্বল মিয়া ও মজিবুর রহমান দীর্ঘদিন ধরে শখের বসে এই কুকুর পালন করে আসছেন।

শৌখিন কুকুর পালনকারী উজ্জ্বল মিয়া বলেন, একটি কুকুর পালনে একজন মানুষের সমান খরচ হয়। খাবার হিসেবে সপ্তাহে অন্তত দুই দিন মাংস, তিন দিন দুধ দিতে হয়। এ ছাড়া জন্মের ৫–৬ মাস পর্যন্ত শুধু দুধ খাওয়াতে হয়। এগুলোর যত্ন করতে হয় রুটিনমাফিক। সুন্দর পরিবেশে রাখতে হয়। নিয়মিত চিকিৎসাসেবা দিতে হয়। কুকুর পালনের খরচ মেটানো অনেকের পক্ষেই এখন আর সম্ভব নয়। তাই এই প্রজাতির কুকুর দিন দিন বিলুপ্ত হচ্ছে।

সরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগ

১৯৮৩ সালে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় উপজেলা সদরে একটি গ্রে-হাউন্ড কুকুর সংরক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছিল। তবে উপযুক্ত চিকিৎসা, সুষ্ঠু পরিচালনা ও আর্থিক সংকটের কারণে কয়েক বছর পরই কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যায়। উপজেলা সদরের বড়দেওয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা শাহজাহান ঠাকুর ২০০১ সালে সরাইলে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কুকুর প্রজননের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর উদ্যোগটিও টেকেনি।

বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ঐতিহ্যবাহী সরাইলের বিরল প্রজাতির মূল্যবান গ্রে-হাউন্ড কুকুর বিলুপ্ত হতে চলেছে।

সরাইল উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, সম্প্রতি প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে তাঁদের কাছে সরাইলের কুকুরের বর্তমান অবস্থা বিষয়ে প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছিল। তাঁরা সেই প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। কিন্তু পরে এর কোনো অগ্রগতি হয়নি। তিনি আরও বলেন, এখনো সরাইলে ৮-১০টি গ্রে-হাউন্ড কুকুর আছে। তা–ও আবার ইতিমধ্যে ৫০ শতাংশ সংকর জাতের হয়ে গেছে। এগুলোকে রক্ষার উদ্যোগ নিলে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পাবে সরাইলের ঐতিহ্য গ্রে-হাউন্ড কুকুর।