সহায়তার তালিকায় ত্রুটি, বঞ্চিত তাঁরা

কিশোরগঞ্জ জেলার ম্যাপ

কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার সমাজসেবা কার্যালয়ের তালিকায় বুলবুল মিয়ার পেশা নরসুন্দর। ব্যবসার ঘর পুরান বাজারে। গতকাল শুক্রবার গিয়ে দেখা যায়, বাজারে বুলবুলের দোকানঘর নেই। বুলবুল এই পেশায় কখনো ছিলেন কি না, তা–ও বলতে পারেননি কেউ। পরে জানা গেছে, বুলবুল মূলত ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাচালক।

অথচ সরকারের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্পের নরসুন্দর সম্প্রদায়ের পেশা উন্নয়নে সরকারের দেওয়া ১৮ হাজার টাকার চেক পেয়েছেন তিনি। শ্রীনগর ইউনিয়নের শ্রীনগর পূর্বপাড়ার বাসিন্দা বুলবুল এ বিষয়ে বলেন, এক বছর আগে নরসুন্দর ছিলেন। ছয় মাস কাজ করেছেন। এখন অটোরিকশা চালান।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নরসুন্দর না হয়েও বরাদ্দকৃত টাকায় শুধু বুলবুল একা ভাগ বসাননি, তালিকায় অন্য পেশার আরও কয়েকজন। ফলে নরসুন্দর অনেকে রয়ে গেছেন তালিকার বাইরে। এই নিয়ে তাঁদের মধ্যে অসন্তোষ চলছে।

সমাজসেবা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, ‘বাংলাদেশ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্প’ নামে সরকারের একটি প্রকল্প চালু রয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সমাজসেবা কর্মকর্তার কার্যালয়। প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ যেন পেশা ছেড়ে না দেয়—এটিই প্রকল্পের উদ্দেশ্য। অর্থ বরাদ্দের জন্য এবার ভৈরবে এই প্রকল্পের অধীন নরসুন্দরদের নির্বাচন করা হয়েছে। প্রতিজনকে ১৮ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়। এবার সুবিধা পেয়েছেন ৩০০ জন। টাকা দেওয়া হয়েছে ব্যাংক চেকের মাধ্যমে।

তালিকা করার জন্য ছয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সভাপতি করা হয় সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের চেয়ারম্যানকে। আর সদস্যসচিব ইউনিয়ন সমাজসেবা কর্মী। সদস্য চারজন ইউপি সদস্য। এক বছর আগে কমিটি করে দেওয়া হয়। কমিটি এক মাস আগে সমাজসেবা কর্মকর্তার কার্যালয়ে তালিকা পাঠায়। এরপর দুই সপ্তাহ আগে থেকে চেক দেওয়া হয়। চেক বিতরণের পরই তালিকার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

উপজেলার শিমুলকান্দি ইউনিয়নের তুলাকান্দি গ্রামের মোহাম্মদ আলী। গ্রামের মাজারের কাছে তাঁর সেলুন। পেশার বয়স ৯ বছর। গিয়ে দেখা গেছে, তিনি কাজ করেন টিনের একটি ছোট্ট ঘরে। চেয়ার একটি, তা–ও ভাঙা। আয়না একটি। আকারে ছোট। চিরুনি, কাঁচিসহ অন্যান্য উপকরণ খুবই পুরোনো। তালিকায় তাঁর স্থান হয়নি।

মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘করোনার আগে আয় দিয়া কোনোরকম সংসার চইলা যাইত। এহন কইম্মা গেছে। গুছানো না বলে লোকজন কম আসে। সরকারি সাহায্যটা পাইলে কিছু জিনিস কেনা যাইত।’

স্থানীয়রা বলেন, গজারিয়া ইউনিয়নে সুবিধাভোগীর তালিকায় আছেন নুরু মিয়া নামের এক ব্যক্তির পরিবারের চারজন। অথচ ওই পরিবারের মাত্র একজন এই পেশার সঙ্গে যুক্ত। সব ইউনিয়নে কমবেশি এমন ত্রুটি রয়েছে। গজারিয়া ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান কাজী গোলাম সারোয়ার বলেন, খোঁজখবর নিয়েই তালিকা করা হয়েছিল। তারপরও কিছু ত্রুটি থেকে যেতে পারে।

তবে শ্রীনগর ইউপি চেয়ারম্যান আবু তাহের জানান, প্রকল্পের সভাপতি হলেও এই তালিকার সঙ্গে পরিষদ যুক্ত ছিলেন না। যা করা হয়েছে সমাজসেবা কার্যালয় থেকে করা হয়েছে।

এদিকে প্রকল্পের সুবিধা পাওয়া ব্যক্তিরা টাকাগুলো কীভাবে ব্যয় করলেন, তা দেখতে শুক্রবার কয়েকটি এলাকায় খোঁজ নেওয়া হয়। গজারিয়া ইউনিয়নের মানিকদী চৌমুরি বাজারের নরসুন্দর বিশ্বনাথ চন্দ্র দাস। তিনি সুবিধাভোগীর একজন। নির্ধারিত স্থানে তাঁর ঘরটি পাওয়া যায়নি। ঘরটি ভেঙে মালিক পাকা ভবন করছেন। তবে বিশ্বনাথ একই বাজারে অন্য একটি ঘরে পেশার কাজ চালিয়ে নিচ্ছেন।

টাকা কী কাজে ব্যবহার করা হয়েছে—এমন প্রশ্নে বিশ্বনাথ জানালেন, ‘আগে চেয়ার ছিল হাতল ছাড়া। এখন হাতল লাগিয়েছি। আয়না কিনেছি দুটি।’

উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা রিফ্‌ফাত জাহান বলেন, তালিকাটি হয়েছে একটি কমিটির মাধ্যমে। এখন কয়েক দিন পর থেকে দেখবেন সুবিধাভোগীরা পেশার মান উন্নয়নে টাকা ব্যয় করেছেন কি না। ব্যতিক্রম হলে কিংবা ঠিকানা অনুযায়ী না পেলে সমস্যা চিহ্নিত করা সহজ হবে।