সাংসদ ডাকলেন স্কুলের মাঠে, বিল ছাড়েননি আন্দোলনকারীরা

সাংসদ শিবলী সাদিকের অপেক্ষায় বসে আছেন লোকজন। কিন্তু সাংসদ সেখানে যাননি। সোমবার দুপুরে দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলায় আশুড়ার বিলেছবি: প্রথম আলো

দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলায় আশুড়ার বিলের মাঝখানে বিশাল শামিয়ানার নিচে মঞ্চ। মঞ্চে সাজানো চেয়ার-টেবিল। সোমবার সকাল থেকে সেখানে উৎসুক লোকজন, সাংসদ শিবলী সাদিক আসবেন। তিনি বিলের মাঝ দিয়ে আড়াআড়ি বাঁধ নির্মাণের বিষয়ে কথা বলবেন। কিন্তু সাংসদ বিলে নয়, গিয়েছেন সেখান থেকে দুই কিলোমিটার দূরে হরিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে।

বিলপাড়ের লোকজনের ভাষ্য, তাঁদের আশা ছিল সাংসদ মানুষের দাবিদাওয়ার কথা শুনবেন। সমস্যার সমাধান হবে। আন্দোলনকারীরা বাড়ি ফিরবেন, কিন্তু তা হয়নি। সাংসদ মুঠোফোনের মাধ্যমে বক্তব্য দেন। তা প্রচার করা হয় মাইকে। এ বক্তব্যে আশ্বস্ত হননি আন্দোলনকারীরা।

আশুড়ার বিলে বাঁধ নির্মাণ বন্ধের দাবিতে ৩১ অক্টোবর বিলপাড়ে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন আশপাশের ১৮-২০ গ্রামের মানুষ। ১ মাস অবস্থান শেষে গত রোববার বাঁধ রক্ষা কমিটির পক্ষে ৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল সাংসদ শিবলী সাদিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। এ দলকে সাংসদ জানান, সোমবার দুপুরে তিনি আশুড়ার বিলে যাবেন।

সোমবার বেলা দুইটার দিকে নবাবগঞ্জ জাতীয় উদ্যানের মাঝের রাস্তা দিয়ে বিলের পশ্চিম প্রান্তে উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারাসহ উপস্থিত হন সাংসদ শিবলী সাদিক। সাংসদকে দেখে এগিয়ে যান উৎসুক জনতা। কিন্তু রাস্তা ভাঙা। জমে আছে বুকপানি। স্থানীয় ব্যক্তিরা নৌকা নিয়ে এগিয়ে যান। কিন্তু পানি পার হয়ে মঞ্চে যেতে রাজি হননি সাংসদ। শেষ পর্যন্ত বিলের পাশ ঘেঁষে বিকল্প রাস্তা ধরে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূরে হরিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে পৌঁছান সাংসদ। সাংসদ বিল থেকে সবাইকে নিয়ে আন্দোলনকারীদের নেতা রেজাউল ইসলামকে বিদ্যালয়ের মাঠে আসতে বলেন। কিন্তু আন্দোলনকারীরা রাজি হননি। এ কারণে মুঠোফোনের মাধ্যমে বক্তব্য দেন সাংসদ। সে বক্তব্য মাইকে প্রচার করা হয়।

আশুড়ার বি‌লে না গিয়ে হ‌রিপুর প্রাথ‌মিক বিদ্যালয়ের মা‌ঠে যান সাংসদ শিবলী সা‌দিক। সোমবার দুপুর সা‌ড়ে তিনটার দিকে
ছবি: প্রথম আলো

মুঠোফোনে দেওয়া ৪ মিনিট ১৩ সেকেন্ডের বক্তব্যে সাংসদ বলেন, ‘শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও আপনাদের কাছে এসেছি। রেজাউল আমাকে বলেননি পশ্চিম পাশে পানি জমে আছে, পারাপার হতে পারব না। বাঁধের পাশে এসে ডাকলাম, আপনারা আসলেন না। আমাকে জানানো হলো, “আপনি হরিপুর স্কুলের মাঠে যান, আমরা যাচ্ছি।” এখানে এসেও বসে থাকলাম। আপনারা ওখানে বসে থাকলেন। প্রশাসন মনে করছে, এমপির নির্দেশনায় আপনারা ওখানে বসে আছেন। আপনারাও আমাকে দোষ দেন। বলির পাঁঠা হচ্ছি আমি। আমি বিষয়টির মধ্যস্থতা করতে আসছিলাম। সবার জ্ঞাতার্থে বলে যাচ্ছি, এ বিল সরকারের। আপনারা দেশের জনগণ। সবার ওপর দায়িত্ব দিয়ে গেলাম। আমি আর অভিযোগের পাত্র হতে চাই না। আমি অসুস্থ মানুষ। আমার জন্য দোয়া করবেন। আমি যদি আপনাদের গ্রামে আসতে পারি, এখন দুটি কথা বলব। বিলের ব্যাপারে সেকেন্ড টাইম কোনো উদ্যোগ আমি নিতে পারব না।’

সাংসদ আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনাদের প্রত্যেকের বাড়ির খবর জানি আমি। সবার অবস্থা জানি। নতুন করে এমপি হইনি। তারপরও ওখানে বসে আছেন। কী প্রমাণ করতে চাচ্ছেন আপনারা। আপনাদের কথা শোনার জন্য আসছি। যা কিছু দেখতাম, সেটাই সরকারকে জানাতাম। বলতাম, আমার এলাকার জনগণের এই পরিস্থিতি। এতটুক জমি বাকি রেখে বাকিটাতে কার্যক্রম করেন। এখন সবকিছু আপনাদের ছেড়ে দিলাম। আপনারা বিল রক্ষা করেন। সরকার সম্ভব হলে তার বিল রক্ষা করবে। মাঝখানে আমি আসতে চাই না। কোনো মধ্যস্থতাও করতে চাই না। এবারের মতো আমাকে রেহাই দেন। সবার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। সমাধান করতে পারলাম না।’

আপনাদের প্রত্যেকের বাড়ির খবর জানি আমি। সবার অবস্থা জানি। নতুন করে এমপি হইনি। তারপরও ওখানে বসে আছেন। কী প্রমাণ করতে চাচ্ছেন আপনারা।
শিবলী সাদিক, সাংসদ, দিনাজপুর–৬

দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ, ফুলবাড়ী ও বিরামপুর উপজেলার ওপর দিয়ে আশুড়ার বিল প্রবাহিত হয়েছে। এ বিলের জমিতে বর্ষা মৌসুমে মাছ ও শুষ্ক মৌসুমে ধান চাষ করেন প্রায় ৩ হাজার কৃষক। এর ওপর ২০–২৫ হাজার মানুষ নির্ভরশীল। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে এ বিলে বৃহত্তর বগুড়া ও দিনাজপুর জেলা ক্ষুদ্র সেচ উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু করে। সে সময় বিলপাড়ের কৃষকেরা বাধা দিলেও বিএডিসি কাজ অব্যাহত রাখে।

গত জানুয়ারিতে প্রথমে রাতে, পরে দিনে প্রশাসনের উপস্থিতিতেই বাঁধ কেটে ফেলেন স্থানীয় ব্যক্তিরা। পরে প্রশাসন বাঁধটি মেরামত করে। পরদিন ২৪ জনের নাম উল্লেখ করে ও তিন শতাধিক ব্যক্তিকে অজ্ঞাতনামা দেখিয়ে মামলা করে প্রশাসন। এবারের বর্ষায় বাঁধটি ভেঙে যায়। প্রশাসন থেকে বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এতে বাধা দিয়ে এক মাস ধরে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছেন আন্দোলনকারীরা।

জানতে চাইলে নবাবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুন নাহার বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে আন্দোলনকারীদের বিষয়টি বুঝিয়ে বলা হয়েছে। এখানে মাছ চাষ থেকে শুরু করে যে ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করা হবে, তাতে স্থানীয় ব্যক্তিদের প্রাধান্য দেওয়া হবে। কিন্তু তাঁরা কথা শোনেননি। এখন প্রশাসন তার মতো করে পদক্ষেপ নেবে।