সাংসদের জয়, নৌকার পরাজয়

এজাজ আহমেদ
এজাজ আহমেদ

খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী এজাজ আহমেদ বিজয়ী হয়েছেন। নৌকা প্রতীকের প্রার্থী মোস্তফা সরোয়ার ওই প্রার্থীর চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ ভোট কম পান। প্রথম দিকে নৌকা প্রতীক পাওয়া নিয়ে জল ঘোলা, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, নেতাদের সমন্বয়ের অভাব, প্রার্থীর দলীয় পদে না থাকা এবং নিজ ইউনিয়নে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ভোট টানতে না পারায় উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর ভরাডুবি হয়েছে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে আওয়ামী লীগের স্থানীয় সাংসদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বিরোধিতাই পরাজয়ের মূল কারণ বলে মনে করছেন স্থানীয় জনগণ ও রাজনীতি–সংশ্লিষ্টরা।

আওয়ামী লীগের অধিকাংশ স্থানীয় নেতা-কর্মী দলীয় প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেননি। এমনকি জেলা পর্যায়ের নেতারাও তাঁর প্রচারণায় ছিলেন না।

চতুর্থ ধাপে গত ৩১ মার্চ খুলনার সব উপজেলার সঙ্গে ডুমুরিয়া উপজেলারও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নৌকা প্রতীক নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত ওই উপজেলার নির্বাচন স্থগিত করার ঘোষণা দেন আদালত। পাশাপাশি ৩ এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচন কমিশনকে প্রতীক বরাদ্দের বিষয়ে অবস্থান ব্যাখ্যা করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। আদালতের ওই রায়ের পর নির্বাচন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে নির্বাচন কমিশন। পরে নতুন করে নির্বাচনের দিন ধার্য করে।

ওই সময় দুই প্রার্থী ও আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নির্বাচনে উপজেলার গুটুদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মোস্তফা সরোয়ারকে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেওয়া হয়। ওই হিসাবে তিনি ইউপি থেকে পদত্যাগ করে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রধানের চিঠিসহ নৌকার মনোনয়নপত্র জমা দেন। অন্যদিকে শাহানওয়াজ হোসেন জোয়াদ্দার স্বতন্ত্র হিসেবে দোয়াত কলম প্রতীক চেয়ে মনোনয়নপত্র জমা দেন। পরে মনোনয়নপত্র যাচাই–বাছাইয়ের আগে শাহানওয়াজ হোসেনকে মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের নিয়মানুযায়ী মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় দলীয় মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া না হলে তা গ্রহণযোগ্য হয় না। ওই নিয়মে শাহানওয়াজের আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন গ্রহণ না করে মোস্তফা সরোয়ারকে নৌকা প্রতীক দেওয়া হয়।

কিন্তু শাহানওয়াজকে কেন নৌকা প্রতীক দেওয়া হবে না তার কোনো ব্যাখ্যা নির্বাচন কমিশন থেকে দেওয়া হয়নি। এ কারণে তিনি আদালতের শরণাপন্ন হন। তবে নির্বাচন কমিশনের ব্যাখ্যার পর আদালত থেকে ওই নির্বাচন নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন তোলা হয়নি।

নির্বাচনের দিন ও পরে এলাকায় ঘুরে এবং তৃণমূল নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্থানীয় সাংসদ ও সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ ডুমুরিয়ার রাজনীতিতে বিশেষ প্রভাব রাখেন। তিনি ওই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও চারবারের সাংসদ। নারায়ণ চন্দ্র আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে না থাকায় ভোটারদের মধ্যে তার প্রভাব ফেলেছে।

>খুলনার ডুমুরিয়ায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী এজাজ আহমেদ নৌকা প্রতীকের প্রার্থী মোস্তফার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ ভোট বেশি পান।

এদিকে নৌকার প্রার্থী মোস্তফা সরোয়ার টানা দুবার স্থানীয় গুটুদিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। তবে দলে তাঁর কোনো পদপদবি নেই।

দলটির নেতা–কর্মীরা বলেন, নৌকার বিপক্ষে সরাসরি অংশ নেন সাংসদের ছেলেসহ অন্য আত্মীয়রা। সাংসদের অনুসারী এবং বিভিন্ন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা সরাসরি নৌকার বিপক্ষে কাজ করেছেন। উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নের মধ্যে ৯টি ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যানরা ছিলেন নৌকার বিপক্ষে।

এদিকে বিজয়ী প্রার্থী ঘোড়া প্রতীকের এজাজ আহমেদ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান গাজী আবদুল হাদীর ছেলে। ছাত্রলীগের সাবেক ওই নেতা সাংসদের আনুকূল্য পেয়েছেন। পাশাপাশি তাঁর বাবার অনুসারীদেরও সমর্থন পেয়েছেন তিনি। এদিকে নির্বাচনে নৌকা প্রতীক না পেয়ে নিষ্ক্রিয় থাকেন প্রার্থী শাহনওয়াজ। তিনি সমর্থন দেন ঘোড়া প্রতীকের এজাজকে।

পরাজয়ের কারণ হিসেবে মোস্তফা সরোয়ার সরাসরি সাংসদকেই দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, ‘সাংসদ আমাকে উপজেলা চেয়ারম্যান হতে দেবে না এমন চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন। নৌকা পেয়েছি বটে তবে আওয়ামী লীগের সমর্থন পাইনি। সাংসদ ও তাঁর অনুসারীরা ভোটারদের বারবার বুঝিয়েছেন এই নৌকা সেই নৌকা নয়। আমার বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালিয়েছেন। বিএনপি সমর্থিত এক ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীকে জিতিয়ে দেওয়ার শর্তে বিএনপির সঙ্গে আঁতাত করেছেন সাংসদ। অনেক এলাকায় তাঁর এজেন্টকে বুথ থেকে জোর করে বের করে দেওয়া হয়েছে।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সাংসদের ছেলে জেলা পরিষদের সদস্য অভিজিৎ চন্দ প্রথম আলোকে বলেন, ‘নৌকা প্রতীক প্রথমে দুজন পেয়েছিলেন। পরে আদালতের সিদ্ধান্তে মোস্তফা সরোয়ার ভাইকে দেওয়া হয়। বাবা আমাকে কোনো পক্ষ নিতে নিষেধ করার আমি নিরপেক্ষ ছিলাম। মানুষ এখন সচেতন। কারও দ্বারা খুব প্রভাবিত হয় না। তাঁরা কাকে বেঁচে নেবে আগে থেকে বলা যায় না। তবে আমার মনে হয়েছে মোস্তফা সরোয়ার ভাই ভালো মানুষ হলেও তাঁর কাছের কিছু মানুষের অতি উৎসাহী ভূমিকার কারণে তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।’

ফলাফল

স্বতন্ত্র প্রার্থী গাজী এজাজ আহমেদ ঘোড়া প্রতীক নিয়ে ৮১ হাজার ২১ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের মোস্তফা সরোয়ার নৌকা প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ৪৪ হাজার ২৫৯ ভোট।

এ ছাড়া পুরুষ ভাইস চেয়ারম্যান পদে গাজী আবদুল হালিম ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে শারমিনা পারভীন নির্বাচিত হয়েছেন।