সাংসদের ভয়ে সাইফুল্লাহর জিডি

যাঁর পক্ষ হয়ে সাংসদ ওসিকে মামলা সাজাতে বলেছিলেন, সেই ফারুকুল অবৈধ ইটভাটাটি চালু রাখতে সব সাংসদেরই আনুকূল্য পান।

কেশবপুরের আলোচিত সুপার ব্রিকস। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে ভেঙে দেওয়ার পর থেকে এভাবেই পড়ে আছে। গতকাল বিকেলে
ছবি: প্রথম আলো

যশোরের কেশবপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) সঙ্গে মুঠোফোনে স্থানীয় সাংসদ শাহীন চাকলাদারের কথোপকথনের অডিও ফাঁসের পর নিজের জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন শেখ সাইফুল্লাহ। গতকাল শনিবার কেশবপুর থানায় এ জিডি করা হয়।

শেখ সাইফুল্লাহর বাড়ি কেশবপুর উপজেলার সাতবাড়িয়া গ্রামে। তিনি বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নেটওয়ার্ক মেম্বার। এলাকায় অবৈধভাবে গড়ে ওঠা একটি ইটভাটার বিরুদ্ধে বেলার সহযোগিতায় হাইকোর্টে রিট করেন তিনি। আদালত ভাটাটি বন্ধের নির্দেশ দেন। আর এতে সাংসদ শাহীন চাকলাদার ক্ষিপ্ত হন সাইফুল্লাহর ওপর।

সপ্তাহ দুয়েক আগে ওসি জসীম উদ্দীনের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন সাংসদ শাহীন। তিনি ওসিকে থানায় বোমা মেরে সাইফুল্লাহর বিরুদ্ধে মামলা করার নির্দেশনা দেন। এটা না পারলে সাদাপোশাকে কোনো একটা ইটভাটায় বোমা মেরে সাইফুল্লাহর বিরুদ্ধে ‘ডাকাতির উদ্দেশ্যে হামলা’র মামলা করতে বলেন।

থানায় করা জিডিতে সাইফুল্লাহ বলেন, ২৯ জানুয়ারি একটি অনলাইন সংবাদপত্রের মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন, স্থানীয় সাংসদ শাহীন চাকলাদার কেশবপুর থানার ওসিকে তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করার জন্য মোবাইল ফোনে চাপ প্রয়োগ করেছেন। সাতবাড়িয়া গ্রামের ইটভাটাটির বিরুদ্ধে এলাবাসীর সঙ্গে তিনিও বেলায় তথ্যপ্রমাণ দেওয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। সাংসদের সঙ্গে ওসির কথোপকথনে তিনি জানমালের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কেশবপুর থানার ওসি জসীম উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, সাইফুল্লাহ জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে থানায় জিডি করেছেন। তাঁর নিরাপত্তার জন্য যে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, সবই করা হবে।

যে ইটভাটা বন্ধে ক্ষিপ্ত হন সাংসদ শাহীন চাকলাদার, সেটির মালিক স্থানীয় ব্যবসায়ী ফারুকুল ইসলাম। কেশবপুর উপজেলার সাতবাড়িয়া বাজারের পাশে কৃষিজমিতে ২০১৭ সালে মেসার্স সুপার ব্রিকস নামে ইটভাটাটি করেন তিনি। স্থানীয় লোকজন জানান, এ ভাটার সামনে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং পাশে বালিকা বিদ্যালয়। আশপাশে জনবসতি ও বাড়িঘর। পরিবেশ বিপর্যয় এবং কালো ধোঁয়ায় ফসল নষ্ট, মানুষের শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে ভোগার কারণে এলাকার কৃষিজমির মালিক ও সাধারণ মানুষ প্রথম থেকেই ভাটার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন। ভাটাটির পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ও জেলা প্রশাসকের অনুমোদন ছিল না। প্রতিবাদ করায় কৃষকদের মারধরও করেন ফারুকুল।

গত ২১ ডিসেম্বর পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রোজিনা আক্তার ভাটার চিমনি এবং কাঁচা ইট ভেঙে দেন। এর আগে ২০১৭ সালের মে মাসে, ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর এবং ২০২০ সালের ২১ মে হাইকোর্টের নির্দেশে মোট তিনবার ভাটাটি বন্ধ করা হয়।

অভিযোগ আছে, বারবার বন্ধ করার পরও ফারুকুল ইসলাম স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করে চার বছর ধরে ইটভাটাটি চালু রেখেছেন। ফারুকুলের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, ভাটার মালিক ফারুকুল ইসলাম সরকারদলীয় সমর্থক, তবে দলে কোনো পদ নেই। আর্থিক সংগতি থাকায় সবকিছুই নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারেন। ওই এলাকায় আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদেরও আনুকূল্য পেয়েছিলেন তিনি।

স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, শাহীন চাকলাদার এ এলাকার সাংসদ হওয়ার পর তাঁর আনুকূল্য পান ইটভাটার মালিক ফারুকুল ইসলাম। এ কারণে ফারুকুলের পক্ষ নিয়ে কেশবপুর থানার ওসিকে ফোন করেছিলেন সাংসদ শাহীন চাকলাদার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফাঁস হওয়া ওই ফোনালাপে থানায় অথবা ইটভাটায় বোমা মেরে সাইফুল্লাহর বিরুদ্ধে মামলা সাজাতে বলা হয়।

অবশ্য শাহীন চাকলাদার গত শুক্রবার প্রথম আলোকে দেওয়া এক বক্তব্যে দাবি করেন, ফাঁস হওয়া অডিওটি টেম্পারিং বা কারসাজি করা। ওসির সঙ্গে তিনি এ ধরনের কোনো কথা বলেননি।

এ বিষয়ে গতকাল প্রথম আলোর কথা হয় ইটভাটার মালিক ফারুকুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ওসিকে সাংসদ কী বলেছেন, তা তো জানি না।’ তাঁর দাবি, ‘সাইফুল্লাহ এলাকায় সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত। কিছু হলেই হাইকোর্টে মামলা করে। মামলা করে আমার ইটভাটাটি বন্ধ করে দিয়েছে। আমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। সাংসদ শাহীন ভাইকে পরিস্থিতির কথা জানিয়েছিলাম একটা মীমাংসার জন্য। এ জন্য হয়তো তিনি কিছু বলেছেন।’

কেশবপুরের এ সংসদীয় আসনে (যশোর–৬) আগে সাংসদ ছিলেন আওয়ামী লীগের ইসমাত আরা সাদেক। তিনি মারা যাওয়ার পর গত জুলাইয়ে উপনির্বাচনে সাংসদ হন শাহীন চাকলাদার।