সাগরে মাছ ধরায় ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা, করোনায় বিপাকে জেলেরা

সাগর থেকে মাছ নিয়ে ফিরেছে ট্রলার। বরগুনার পাথরঘাটার বিএফডিসি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে
ফাইল ছবি

দেশের মৎস্য সম্পদের সুরক্ষা ও মাছের বংশবিস্তারে সাগরে মাছ ধরার ওপর ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা শুরু হচ্ছে। ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে। নিষেধাজ্ঞার দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন উপকূলের লাখো জেলে।

জেলেরা বলছেন, এমনিতেই করোনাকালে তাঁদের রোজগারে টান পড়েছে। তার ওপর সাগরে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা থাকায় কীভাবে পরিবার চলবে, এ নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে আছেন তাঁরা। নিষেধাজ্ঞা চলকালে জেলেরা খাদ্যসহায়তা হিসেবে চাল পান। চালের পাশাপাশি তাঁদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা ৬৫ দিন দরকার আছে কি না, তা বৈজ্ঞানিকভাবে বিচার–বিশ্লেষণ করে দেখা উচিত। কারণ, প্রতিবেশী দেশ ভারতে এই নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা ১৫ এপ্রিল থেকে ৪৫ দিন পর্যন্ত। দেশে এই সময়সীমা ১ মে থেকে ৩০ জুন করা হলে তা বেশি কার্যকর হতে পারে।

বরগুনার পাথরঘাটা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই এই নিষেধাজ্ঞা পুনর্বিবেচনার দাবি করে আসছি। গরিব জেলেরা সাগরে নামতে না পারলে খাবেন কী? তাই বাধ্য হয়ে পেটের দায়ে অনেক জেলে জেল-জরিমানার ভয় উপেক্ষা করেন। তবে বেশির ভাগ জেলে ও ট্রলারমালিক আইন মেনে সাগরে যান না।’

মেরিন ফিশারিজ অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী, বঙ্গোপসাগরে প্রতিবছর ৬৫ দিন মাছ ধরা নিষিদ্ধ। ২০১৫ সালে এই নিষেধাজ্ঞা চালু হয়। শুরুতে শুধু ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রলার এর আওতায় থাকলেও ২০১৯ সালে সব ধরনের নৌযানকে এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হয়।

মৎস্য অধিদপ্তর জানায়, সরকার এই নিষেধাজ্ঞার সময় জেলেদের খাদ্যসহায়তা দেয়। এরই মধ্যে জেলেদের জন্য ১৬ হাজার ৭২১ মেট্রিক টন ভিজিএফের চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর আওতায় উপকূলের ১৪টি জেলার ৬৬টি উপজেলায় ২ লাখ ৯৮ হাজার ৫৯৫টি জেলে পরিবার ৫৬ কেজি করে চাল পাবে।

তবে নিষেধাজ্ঞার সময় যে চাল দেওয়া হয়, তাতে এক মাসেরও খোড়াক হয় না। বরগুনার তালতলীর জয়ালভাঙার জেলে আলম মিয়া বলেন, একটা গ্রামে ৫০০ জেলে থাকলে চাল পান ১০০ জন। যাঁরা পান, তাঁদের আবার ওজনে কম দেওয়া হয়। জেলে নন, এমন লোকেরাও চাল পান। জনপ্রতিনিধিসহ অনেকে জেলেদের চালে ভাগ বসান বলে অভিযোগ করেন এই জেলে।

সাগর থেকে মাছ নিয়ে ফিরেছে ট্রলার। বরগুনার পাথরঘাটার বিএফডিসি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে
ফাইল ছবি

এদিকে নিষেধাজ্ঞার দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসায় কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে বরিশালসহ দক্ষিণ উপকূলের জেলেদের। পটুয়াখালীর মহিপুরের জেলে কালাম শরীফের কথায় এর আভাস পাওয়া গেল। কালাম বললেন, ‘করোনায় মোগো মেরুদণ্ড ভাইঙা দেছে। হ্যার পর ২২ দিনের ইলিশের অবরোধ (নিষেধাজ্ঞা), ৮ মাসের জাটকা ধরার অবরোধ। এখন গাঙ্গে-সাগরেও তেমন মাছ-পোনা নাই। এহন আবার ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা। ক্যামনে যে বউ-বাচ্চা লইয়্যা বাঁচমু, কইতে পারি না!’

এমন উদ্বেগের কথা জানালেন বরগুনার তালতলী উপজেলার সোনাকাটা গ্রামের জেলে শামীম মিয়া। তিনি বললেন, ‘নিষেধাজ্ঞায় নিষেধাজ্ঞায় মোরা নিঃস্ব অইয়্যা গেছি। গত সরকারি সহায়তা বলতে ৫৫ কেজি চাউল পাইছিলাম। চাউল দিয়া কি খালি খিদা মেটে, কন?’

নিষেধাজ্ঞার সময় সরকার খাদ্যসহায়তা দিচ্ছে। এর পাশাপাশি তাঁদের অন্তত দুই হাজার করে টাকা দেওয়া যেতে পারে। কারণ, জেলেদের দীর্ঘমেয়াদে ত্যাগের জন্য দেশে ইলিশসহ অন্য মাছের উৎপাদন বেড়েছে। দুই মাস মাছ না ধরে জেলেরা পরিবেশকে যে সহায়তা করলেন, সে জন্য পরিবেশের দায় (পেমেন্ট ফর ইকোসিস্টেম) হিসেবে দেশে উৎপাদিত মাছ থেকে এক টাকা করে সঞ্চয় করে সেটা আবার জেলেদের কল্যাণে ব্যয় করা যায় কি না, সেটাও ভাবা যেতে পারে।
আবদুল ওহাব, মৎস্য বিজ্ঞানী

ইতিপূর্বে মাছ ধরার ওপর ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা ও করোনাকালের ছুটিতে জেলেদের কতটা ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে, তা নিরূপণের জন্য গত বছর ‘সাসটেইনেবল ওশানস’ প্রকল্পের পক্ষ থেকে একটি জরিপের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ও ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের সেন্টার ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট বিভাগ চট্টগ্রামের মহেশখালী ও বরগুনার পাথরঘাটার জেলে ও মাছ ধরার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ১ হাজার ৬১ জনের ওপর যৌথভাবে জরিপটি পরিচালনা করে।
জরিপ থেকে পাওয়া চিত্রে দেখা যায়, জেলেরা এই সময়ে জীবিকার প্রশ্নে সমস্যায় পড়েন। তাঁরা মূলত মাছ ধরার ওপর নির্ভরশীল এবং এর পাশাপাশি অন্য কোনো ধরনের কাজের দক্ষতা না থাকায় তাঁদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ দিনমজুরি করতে বাধ্য হন। অন্য এক-তৃতীয়াংশ কর্মহীন অবস্থায় কাটান। করোনার প্রাদুর্ভাবের আগে যেখানে তাঁদের পারিবারিক দৈনিক আয় ছিল গড়ে ৩৭১ টাকা। ৬৫ দিনের মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা চলাকালে এ আয় আরও কমে ১০৭ টাকায় পৌঁছায়।

জেলেদের আয় কমে যাওয়ায় পরিবারে পুষ্টির ঘাটতির বিষয়টি মাথায় রেখে এবার পরীক্ষামূলকভাবে কক্সবাজার অঞ্চলে ৩ হাজার জেলে পরিবারকে আধা কেজি করে শুঁটকি মাছ দেবে আন্তর্জাতিক মৎস্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ডফিশের ইকোফিশ-বাংলাদেশ প্রকল্প।

ইকোফিশ-বাংলাদেশ প্রকল্পের দলনেতা ও মৎস্য বিজ্ঞানী আবদুল ওহাব প্রথম আলোকে বলেন, ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্তটি দেশের মৎস্য সম্পদ, জীববৈচিত্র্য ও মানুষের কল্যাণে করা হয়েছে। তবে সেটা ৬৫ দিনের জন্য প্রয়োজন আছে কি না, সেটা বৈজ্ঞানিকভাবে তথ্য–উপাত্ত বিচার–বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। এটা ১ মে থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত করলে অধিকতর কার্যকর হবে বলে মনে করেন এই মাৎস্য বিজ্ঞানী।

আবদুল ওহাব বলেন, নিষেধাজ্ঞার সময় সরকার খাদ্যসহায়তা দিচ্ছে। এর পাশাপাশি তাঁদের অন্তত দুই হাজার করে টাকা দেওয়া যেতে পারে। কারণ, জেলেদের দীর্ঘমেয়াদে ত্যাগের জন্য দেশে ইলিশসহ অন্য মাছের উৎপাদন বেড়েছে। দুই মাস মাছ না ধরে জেলেরা পরিবেশকে যে সহায়তা করলেন, সে জন্য পরিবেশের দায় (পেমেন্ট ফর ইকোসিস্টেম) হিসেবে দেশে উৎপাদিত মাছ থেকে এক টাকা করে সঞ্চয় করে সেটা আবার জেলেদের কল্যাণে ব্যয় করা যায় কি না, সেটাও ভাবা যেতে পারে।