সাতক্ষীরায় প্রাণসায়ের খাল খনন যেনতেন উপায়ে হচ্ছে বলে অভিযোগ

পানি না শুকিয়ে খাল খননের নামে যেনতেনভাবে এক্সকাভেটর মেশিন দিয়ে কাদা তুলে রাখা হচ্ছে পাড়ে। সাতক্ষীরা শহরের পোস্ট অফিস মোড় এলাকায়। সম্প্রতি তোলা ছবিপ্রথম আলো

সাতক্ষীরা শহরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত সাতক্ষীরার প্রাণ ‘প্রাণসায়ের খাল’ খনন নকশা অনুযায়ী হচ্ছে না বলে অভিযোগ পাওয়া হচ্ছে। ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে উত্তর-দক্ষিণ লম্বা ১৪ কিলোমিটার এই খাল খনন করা হচ্ছে যেনতেন উপায়ে। শুধু এক্সকাভেটর মেশিন দিয়ে খাল থেকে কাদা তুলে দেওয়া হচ্ছে পাড়ে। খনন শেষ করার আগে অনেক স্থানের পাড় ধসে পড়ছে। ২০২০ সালের ৩০ জুনের মধ্যে খননকাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও কাজ এখনো শেষ হয়নি। কবে শেষ হবে, তারও ঠিক নেই।

সাতক্ষীরা শহরের একাধিক বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৮৫০ সালের দিকে সাতক্ষীরার জমিদার প্রাণনাথ রায় চৌধুরী নদীপথে ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধা ও শহরের শ্রীবৃদ্ধির জন্য একটি খাল খনন করেন। মরিচ্চাপ নদের সঙ্গে বেতনা নদীর সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য এ খালটি খনন করা হয়। এল্লারচর থেকে খেজুরডাঙ্গী পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার লম্বা খনন করা খালটি প্রাণনাথ রায় চৌধুরীর নাম অনুসারে প্রাণসায়ের খাল হিসেবে পরিচিতি পায়। সাতক্ষীরা শহরের বুক চিরে উত্তর-দক্ষিণে বয়ে যাওয়া খালটি একসময় শহরের শ্রীবৃদ্ধি ঘটিয়েছিল। খুলনা, বরিশাল, ঢাকা, কলকাতাসহ বিভিন্ন স্থানের সঙ্গে প্রধান যোগাযোগের মাধ্যম ছিল এ খাল। এর মাধ্যমে সহজ হয়ে উঠেছিল জেলার অভ্যন্তরীণ যোগাযোগও।

প্রবীণ বাসিন্দা শেখ আফসার হোসেন ও ইদ্রিস আলী বলেন, প্রাণসায়ের খাল ভরাট ও দখল হওয়ার পর নতুন করে খনন করা হচ্ছে। কিন্তু যেভাবে খনন করা হচ্ছে, তাতে প্রাণসায়ের প্রাণ ফিরে পাওয়া তো দূরের কথা, শুধু অর্থের অপচয় হবে।

খনন শেষ করার আগে অনেক স্থানের পাড় ধসে পড়ছে। ২০২০ সালের ৩০ জুনের মধ্যে খননকাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও কাজ এখনো শেষ হয়নি। কবে শেষ হবে, তারও ঠিক নেই
প্রথম আলো

সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (বিভাগ-২) নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, সাতক্ষীরার সদর উপজেলার এল্লারচর থেকে খেজুরডাঙ্গী পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার খাল খননের প্রাক্কলিত ব্যয় ১০ কোটি ১৩ লাখ টাকা। নকশা অনুযায়ী এই খাল কাটার কথা। খালের উপরিভাগের প্রস্থ হতে হবে ৭৫ থেকে ৮০ ফুট। গভীরতা ৬ থেকে ৮ ফুট ও তলদেশের প্রস্থ হবে ২৫ ফুট। এ খাল কাটার জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয় ২০১৯ সালের জুলাই মাসে। খাল খননের কার্যাদেশ দেওয়া হয় ২০১৯ সালের ১ আগস্ট। শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালের ৩০ জুন। কিন্তু এখনো কাজ শেষ হয়নি।

সাতক্ষীরা শহরের চালতে তলা এলাকা থেকে পোস্ট অফিস মোড় পর্যন্ত ঘুরে দেখা গেছে, নকশা অনুযায়ী খাল কাটা হচ্ছে না। যেনতেন উপায়ে কাদা তুলে পাড়ে দেওয়া হচ্ছে বা পাশে রাখা হচ্ছে। খালের উপরিভাগের প্রস্থ কোথাও কোথাও ৫৫ ফুটের বেশি হচ্ছে না। ৩-৪ ফুটের বেশি গর্ত করা হচ্ছে না। খননের পর তলদেশের প্রস্থ ১৫ থেকে ১৮ ফুটের বেশি নয়। খাল শুকিয়ে কাটার কথা থাকলেও কাটা হচ্ছে পানি রেখেই। পচা কাদা বহন করা হচ্ছে শহরের ওপর দিয়েই। এসব কাদা সড়কে পড়ে শুকিয়ে শহরময় ধুলো ছড়িয়ে পড়ছে।

সাতক্ষীরা শহরের বীর মুক্তিযোদ্ধা হাসনে জাহিদ বলেন, ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে এ খাল খননের নামে অর্থ অপচয় হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান লাভবান হচ্ছে। এক বর্ষা মৌসুম যেতে না যেতেই খাল আগের অবস্থায় ফিরে আসবে।

নকশা অনুযায়ী এই খাল কাটার পর উপরিভাগের প্রস্থ হতে হবে ৭৫ থেকে ৮০ ফুট। গভীরতা ৬ থেকে ৮ ফুট ও তলদেশের প্রস্থ হবে ২৫ ফুট। তা না করে যেনতেনভাবে পানি না শুকিয়েই খাল খননের নামে এক্সকাভেটর মেশিন দিয়ে কাদা তুলে রাখা হচ্ছে পাড়ে। সাতক্ষীরা শহরের পাসপোর্ট অফিসের সামনে। সম্প্রতি তোলা ছবি
প্রথম আলো

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মাসুদ অ্যান্ড টেকনিক লিমিটেডের অংশীদার ডন মোহাম্মদ বলেন, তাঁরা গত বছরই শহরের বাইরের অংশে কাজের নকশা অনুযায়ী কাজ শেষ করেছেন। কিন্তু নকশা অনুযায়ী শহরের অংশে কাজ করতে পারছেন না উল্লেখ করে তিনি বলেন, খালের দুই পাশে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ছাড়াও কয়েকটি স্থাপনা রয়েছে। ওই স্থানে নকশা অনুযায়ী খাল কাটা যাচ্ছে না। তারপরও চেষ্টা করা হচ্ছে।

সাতক্ষীরা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল খায়ের বলেন, প্রাণসায়ের খাল খনন ২০২০ সালের ৩০ জুনের মধ্যে শেষ করার কথা থাকলেও নানা জটিলতায় তা হয়নি। এ জন্য চলতি ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়েছে। খালপাড়ের মানুষ মামলা করায় ও এক্সকাভেটর মেশিন চলাচলের জন্য জায়গা বের করতে দেরি হওয়ায় কাজ করতে দেরি হচ্ছে। বিশেষ করে শহর অংশে নকশা অনুযায়ী কাজ হচ্ছে না স্বীকার করে নিয়ে বলেন, পরে আবার খাল আরও খনন করতে হবে। না হলে বিল দেওয়া হবে না।