সাময়িক লাভে বড় ক্ষতি

জমির প্রকারভেদে ৪ থেকে ৮ ফুট গভীর করে মাটি কাটা হচ্ছে। এতে বদলে যাচ্ছে ভূমির শ্রেণি। কমে যাচ্ছে উর্বরতা।

ইটভাটায় মাটি সরবরাহের জন্য খনন করা হচ্ছে জমি। এতে বদলে যাচ্ছে জমির শ্রেণি। গতকাল বিকেলে পীরগঞ্জের চাপোড় গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলায় আমন ধান কাটা শেষ করেই আবাদি জমির উপরিভাগের মাটি বিক্রি হচ্ছে নানা ইটভাটায়। এতে জমির মালিকেরা আর্থিকভাবে সাময়িক লাভবান হলেও মাটির উর্বরতা শক্তি কমে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন কৃষি কর্মকর্তারা।

গত বছরের নভেম্বর মাস থেকে উপজেলার ইটভাটার আশপাশের জমির উপরিভাগের মাটি কাটার দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। জমির প্রকারভেদে ৪ থেকে ৮ ফুট গভীর করে মাটি কাটা হচ্ছে। এতে বদলে যাচ্ছে ভূমির শ্রেণি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেছেন, ফসলি জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা অপরাধ।

উপজেলার কয়েকটি ইটভাটার আশপাশে বসবাসকারী স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একশ্রেণির মাটি ব্যবসায়ী (দালাল) কৃষকদের সঙ্গে মাটির দরদাম করেন। পরে ওই মাটি বিক্রি করেন ইটভাটার মালিকের কাছে। এসব ব্যবসায়ী বছরের বিভিন্ন সময়ে কম মূল্যে বিঘা বা একর চুক্তিতে ফসলি জমির মাটি কিনে রাখেন। ভাটার মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই খননযন্ত্রের সাহায্যে এসব মাটি কেটে তা বেশি মূল্যে ইটভাটায় সরবরাহ করেন।

ঠাকুরগাঁও জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবু হোসেন মুঠোফোনে বলেন, ফসলি জমির উপরি স্তরের ৭ থেকে ১০ ইঞ্চির মধ্যে জৈব উপাদান ও খাদ্য গুণাগুণ থাকে। তাই এই স্তরটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই স্তরের মাটি সরানো হলে ফসলের উৎপাদন কমে যায়। একবার ফসলি জমির মাটি কাটা হলে আগের অবস্থায় ফিরে যেতে ৮-৯ বছর লাগে।

১৮, ১৯ ও ২০ জানুয়ারি পীরগঞ্জের খনগাঁও, উত্তর গড়গাঁও, বৈরচুনা, মল্লিকপুর, নানুহর, ভেলাতৈড়, চাপোড়, সিন্দুরনা, দৌলতপুর ও সিরাইল গ্রাম ঘুরে বিভিন্ন ফসলি জমির মাটি কাটার দৃশ্য দেখা গেছে। আমন ধান কাটা শেষ হওয়ার পর থেকেই এসব জমিতে ৬-৭ ফুট গভীরতায় মাটি কাটা শুরু হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুটি ইটভাটার মালিক বলেন, প্রতি ট্রলিতে ১০০ ঘনফুট মাটি বহন করা যায়। এই পরিমাণ মাটি দিয়ে দুই হাজার ইট তৈরি হয়। সে অনুযায়ী, ইট ভাটায় ১ লাখ ইট তৈরি করতে ৫০ থেকে ৬০ হাজার ঘনফুট মাটি দরকার হয়।

এই মালিকেরা আরও বলেন, একটি ভাটায় এক মৌসুমে ৮-৯ লাখ ইট তৈরি করা হয়। মাটি দরকার হয় চার থেকে সোয়া চার লাখ ঘনফুট। পীরগঞ্জ উপজেলায় ১৬টি ইটভাটা আছে। সব মিলিয়ে এ মৌসুমে ৬৫-৭০ লাখ ঘনফুট মাটির দরকার। এই পরিমাণ মাটির বেশির ভাগই ফসলি জমি থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে।

বৈরচুনার এস আর বি ইটভাটার মালিক খায়রুল আলম ও খনগাঁওয়ের এন বি ইটভাটার মালিক আবদুস সাত্তার বলেন, উপজেলার ১৩-১৪টি ভাটায় আগুন দেওয়া হয়েছে। আর বাকিগুলোতে প্রস্তুতি চলছে। দেড় থেকে দুই মাস আগেই ভাটার মালিকেরা মাটি সংগ্রহ শুরু করেছেন। উপজেলার ৯৫-১১০ জন ব্যবসায়ী ভাটায় মাটি সরবরাহের কাজে জড়িত।

জাবরহাট গ্রামের মাটি ব্যবসায়ী তোফাজ্জল হোসেন বলেন, তিনি ইটভাটার শ্রমিকের কাজ ছেড়ে ৪-৫ বছর থেকে মাটি কেনাবেচা করছেন। প্রতি বিঘা জমি থেকে ৮ ফুট মাটি কাটার বিনিময়ে কৃষককে ৫০ থেকে ৫৫ হাজার টাকা দিতে হবে—এমন চুক্তিতে বৈরচুনা ও জাবরহাট গ্রামের পাঁচ কৃষককে কিছু অগ্রিম টাকা দিয়ে জমিগুলো ধরে রেখেছেন। খননযন্ত্র পেলেই মাটি কাটা শুরু করবেন।

উপজেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি মো. শাহজাহান দাবি করেন, পুঁজির সংকটসহ বিভিন্ন কারণে চলতি মৌসুমে উপজেলায় ২-৩টি ভাটা কমে যাচ্ছে। তিনি নিজের একটি ভাটা বন্ধ করে দিয়েছেন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে ভাটাগুলো আগামী বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত চালু থাকবে।

সেভেন বি ইটভাটার মালিক ও মালিক সমিতির কোষাধ্যক্ষ আবু জহিদ বলেন, কেউ জমি খাল করার প্রয়োজনে আবার কেউ ব্যবসার জন্য ভাটায় মাটি বিক্রি করেন। তাঁরা চাপ দিয়ে কোনো কৃষকের ফসলি জমির মাটি ভাটায় নেন না।

ফসলি জমির মাটি কেটে ইটভাটায় বিক্রির কথা জানেন ইউএনও রেজাউল করিম। তিনি বলেন, এই কাজ বেআইনি। এর সঙ্গে জড়িত ভাটার মালিক ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে শিগগিরই ব্যবস্থা নেবেন।