সালথায় এসি ল্যান্ডের গাড়ি থেকে নেমে মারধরের সত্যতা মেলেনি

ফরিদপুরের সালথা উপজেলা পরিষদে বিক্ষুব্ধ লোকজনের দেওয়া আগুনে পুড়ে যাওয়া গাড়ি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বাসভবনের গ্যারেজে
ফাইল ছবি

ফরিদপুরের সালথায় সহকারী কমিশনারের (ভূমি) গাড়ি থেকে মানুষকে মারধরের কোনো সত্যতা পায়নি জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি। ৫ এপ্রিল বিকেলে সালথার ফুকরা বাজারে এসি ল্যান্ডের গাড়ি থেকে নেমে দু–তিনজন মানুষকে পেটানোর ‘গুজব’ ছড়িয়ে পড়লে ওই দিন রাতে উপজেলার বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে তাণ্ডব চালান স্থানীয় একদল মানুষ।

এদিকে ওই দিনের তাণ্ডবে উপজেলা পরিষদের বিভিন্ন দপ্তরে ২ কোটি ৩৬ লাখ ৯৮ হাজার ৫৩৮ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে জেলা প্রশাসনের আরেকটি তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

কী কারণে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে, তা খতিয়ে দেখতে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তাসলিমা আলীকে আহ্বায়ক করে ছয় সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। ৬ এপ্রিল গঠিত ওই কমিটিকে তিন কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। কমিটি আজ রোববার ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক অতুল সরকারের হাতে তদন্ত প্রতিবেদন তুলে দেয়।

জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক অতুল সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসি ল্যান্ড এক ব্যাক্তিকে পিটিয়ে মাজা ভেঙ্গে দিয়েছে’, ‘একজন হুজুরকে পুলিশ আটক করেছে’, ‘পুলিশের গুলিতে চার–পাঁচজন নিহত হয়েছে’— এ জাতীয় নানা ধরনের গুজব রটিয়ে পরিকল্পিতভাবে সালথায় ওই দিন সহিংস তাণ্ডব সৃষ্টি করা হয়েছে। এ কথাগুলো তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। তবে এ তাণ্ডবের পেছনে কোন কোন শক্তি কী কী উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করেছে তা পুলিশি তদন্তে বের হয়ে আসবে।

জেলা প্রশাসক আরও বলেন, ‘এসি ল্যান্ড এক বৃদ্ধ ব্যক্তিকে পিটিয়ে মাজা ভেঙে দিয়েছে’—এ গুজবের কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। তদন্ত প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘এসি ল্যান্ড ওই বাজারে গাড়ি থেকেই নামেননি। এমনকি তাঁর গাড়ি থেকে অন্য কেউ নেমেও কোনো দোকানদারকে পিটুনি দেননি।’

জেলা প্রশাসক অতুল সরকার বলেন, এসি ল্যান্ডের ভূমিকার বিষয়টি প্রশাসনের পক্ষ থেকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে কঠিনভাবে তদন্ত করে দেখেছেন। তাঁকে (এসি ল্যান্ড) অনেক জেরা করা হয়েছে। তিনি বলেন, ওই তদন্ত কমিটির পাশাপাশি প্রশাসনিক একটি তদন্ত কমিটিও এসি ল্যান্ডের ভূমিকা নিয়ে তদন্ত করেছে। সে কমিটিতে আন্তর্জাতিক মানের একটি এনজিওর একজন প্রতিনিধিও ছিলেন। সে প্রতিবেদনেও এসি ল্যান্ডের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি।

ক্ষয়ক্ষতি প্রায় আড়াই কোটি টাকা

সালথায় সহিংস তাণ্ডবের ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি পরিমাপের জন্য আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ছয় সদস্যবিশিষ্ট এ তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ফরিদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আসলাম মোল্লা। আসলাম মোল্লাও আজ এ–সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন জেলা প্রশাসকের কাছে জমা দিয়েছেন। ওই প্রতিবেদনে মোট ২ কোটি ৩৬ লাখ ৯৮ হাজার ৫৩৮ টাকার ক্ষতি হয়েছে। গণপূর্ত বিভাগের কর্মকর্তারা ক্ষয়ক্ষতির এ পরিমাণ নির্ধারণ করেছেন।

জেলা প্রশাসনের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ওই দিনের হামলা ও নাশকতামূলক কাজে উপজেলা ভূমি অফিসের ক্ষতি হয়েছে ২৬ লাখ ৪৩ হাজার ৮৩০ টাকা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের ক্ষতি হয়েছে ৫ লাখ ২৬ হাজার ১২৯ টাকা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বাসার ক্ষতি হয়েছে ১২ লাখ ৩৩ হাজার ৬০৯ টাকার, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয়ের ক্ষতি হযেছে ২ লাখ ৬৭ হাজার ৩৮৮ টাকা, উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ের ক্ষতি হয়েছে ১ লাখ ২৬ হাজার ২৪০ টাকা, উপজেলা বন অফিসের ক্ষতি হয়েছে ২৫ হাজার ৮৬৬ টাকা, পিআইও এবং গোডাউনের ক্ষতি হয়েছে ২ লাখ ৭৯ হাজার ৫৭ টাকা, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের বাড়ির ক্ষতি হয়েছে ৮০ হাজার ৯২৩ টাকা, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে ক্ষতি হয়েছে ৭ হাজার ৯৩৩ টাকা, ভাইস চেয়ারম্যানের কার্যালয়ের ক্ষতি হয়েছে ৩২ জাহার ৭৩২ টাকা, সংরক্ষিত মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানের কার্যালয়ের ক্ষতি হয়েছে ২৩ হাজার ৭৯৯ টাকা।

উপজেলা ডিজিটাল সেন্টারের ক্ষতি হয়েছে ৫২ হাজার ১০৫ টাকা, হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার কার্যালয়ের ক্ষতি হয়েছে ৪৬ হাজার ৭৩২ টাকা, যুব উন্নয়ন কার্যালয়ের ক্ষতি হযেছে ১৫ হাজার ৮৬৬ টাকা, মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়ের ক্ষতি হয়েছে ৭ হাজার ৯৩৩, পুরোনো ভূমি অফিসের ক্ষতি হয়েছে ১৫ হাজার ৮৬৬ টাকা, মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের ক্ষতি হয়েছে ১ লাখ ৪ হাজার ৮৯৩ টাকা, পুকুরঘাটের ক্ষতি হয়েছে ৬০ হাজার টাকা।

এসি ল্যান্ডের গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ায় ক্ষতি হয়েছে ৪৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা, ইউএনওর পাজেরো গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ায় ক্ষতি হয়েছে ৯৯ লাখ টাকা। ৪টি মোটর সাইকেল পুড়িয়ে ও ভেঙে ফেলায় ক্ষতি হয়েছে ৩ লাখ ২০ হাজার ৫০০ টাকা এবং বৈদ্যুতিক কাজের ক্ষতি হয়েছে ৩০ লাখ ৮৮ হাজার ১৩১ টাকা।

৫ এপ্রিল রাতে গুজবকে কেন্দ্র করে ফরিদপুরের সালথা উপজেলায় ব্যাপকভাবে সহিংস তাণ্ডব চলে। এ ঘটনায় পুলিশের গুলিতে দুজন নিহত হন। পরবর্তী সময়ে এ ঘটনায় পাঁচটি মামলা করা হয়। এ মামলাগুলোতে ২৬১ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা আরও ৪ হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়।

আরও পড়ুন