সিঙ্গাইরে ভালো নেই সবজিচাষিরা

খেত থেকে ওলকপি তুলছেন এক চাষি। চর ভাকুম গ্রাম, সিঙ্গাইর, মানিকগঞ্জ, ১১ ডিসেম্বর দুপুর
প্রথম আলো

গত বছর এক বিঘা জমিতে শীতের সবজি ওলকপির আবাদ করেছিলেন মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার চর ভাকুম গ্রামের চাষি সবেজ উদ্দিন ফকির (৫৫)। লাভ ভালোই পেয়েছিলেন। এবারও ওই জমিতে ওলকপির আবাদ করেছেন, আবাদও হয়েছে ভালো। তবে সেই লাভের স্বপ্ন তাঁর ভেস্তে গেছে। উৎপাদনের খরচ ওঠাতে হিমশিম অবস্থা তাঁর।

গত বুধবার ওই গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, খেত থেকে ওলকপি তুলছেন সবেজ উদ্দিন। পাশে স্ত্রী আমেনা বেগম ওলকপি থেকে পাতা ছাড়াচ্ছেন। আর কিশোর ছেলে রফিকুল ইসলাম তা সাজিতে তুলে রাখছে। এ সময় কথা হয় তাঁদের সঙ্গে। সবেজ উদ্দিন বলেন, গত বছর খেত থেকেই পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে প্রতি কেজি ওলকপি ৩৫ টাকা দরে ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছিলেন। এবার পাইকারের দেখা নেই। স্থানীয় বাজারে ১৭-১৮ টাকায় প্রতি কেজি ওলকপি বিক্রি করছেন। লাভের আশা ছেড়ে দিয়েছেন।
শুধু এই সবজিচাষিই নন, উপজেলার অনেকে সবজি আবাদ করে ভালো নেই। করোনার প্রভাবে চাহিদা কমে যাওয়া, বন্যা-অতিবৃষ্টি, স্থানীয় বাজারব্যবস্থা গড়ে না ওঠা এবং সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় সবজির উপজেলা হিসেবে খ্যাত সিঙ্গাইরের চাষিদের এবার উপার্জনে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

উপজেলা কৃষি বিভাগ ও ১০–১২ জন চাষির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সিঙ্গাইরে বাণিজ্যিকভাবে মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, চিচিঙ্গা, বেগুন, গাজর, টমেটো, শসা, ঢ্যাঁড়স, পেঁপে, করলা, লাউ, ফুলকপি, ওলকপি, বাঁধাকপি, পটোল, শিম, বরবটি, মুলা, লাউশাক, লালশাক, পুঁইশাক, পাটশাক, পালংশাক, কাঁচা মরিচসহ বিভিন্ন সবজির চাষ হয়। এতে বেশ আগে থেকেই সিঙ্গাইর সবজির এলাকা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। শায়েস্তা, চান্দহর, জয়মন্টপ, বায়রা, ধল্লা ও সিঙ্গাইর সদর ইউনিয়নে এসব সবজির চাষ হয়ে থাকে।

গত বছর উপজেলায় ২ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে শীতকালীন বিভিন্ন সবজির আবাদ হয়। এতে ৫১ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন সবজির আবাদ হয়। এবার উপজেলার ৩ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমিতে শীতকালীন বিভিন্ন সবজির চাষ করা হয়।

এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা টিপু সুলতান প্রথম আলোকে বলেন, এবারের বন্যায় ও বৃষ্টিতে কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। করোনায় সবজির চাহিদা কিছুটা কমেছে। ন্যায্যমূল্য পেতে উৎপাদিত এসব সবজি বাজারজাতকরণে ঢাকা এবং এর আশপাশের বিভিন্ন বাজারে পাইকার ও চাষিদের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। স্থানীয় বাজারব্যবস্থা নিয়ে সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। তিনি বলেন, সরকারিভাবে সবজি সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকলে কৃষকেরা উপকৃত হতেন।

এই উপজেলায় সাধারণত বন্যার পানি না ঢোকায় সারা বছরই চাষিরা সবজির আবাদ করেন। তবে এ বছর বন্যায় অধিকাংশ এলাকায় পানি ঢুকে ক্ষতির মুখে পড়েন চাষিরা। সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আবাদ শুরু করেন শীতের সবজির। তবে আগাম চাষ করতে না পারায় সবজিতে দাম পাচ্ছেন না চাষিরা।

জয়মন্টপ ইউনিয়নের চর দুর্গাপুর গ্রামের চাষি নূরু হক (৫২) বলেন, ঢাকার পাশে হওয়ায় এই উপজেলার উৎপাদিত বিভিন্ন সবজি ঢাকা, সাভার ও গাজীপুরের বিভিন্ন বাজার ও আড়তে পাঠানো হয়। এবার করোনায় পোশাক কারখানাসহ বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানে কর্মী ছাঁটাই করা হয়। এসব কর্মীর অনেকে গ্রামে চলে যাওয়ায় ঢাকা, গাজীপুরসহ আশপাশের এলাকাগুলোতে এখানকার সবজির চাহিদাও কমে গেছে। এতে চাষিরা সবজির আশানুরূপ দাম পাচ্ছেন না।

একই গ্রামের চাষি আলামিন বলেন, বর্ষার আগে ৭ বিঘা জমিতে পেঁপে, ১১ বিঘায় চালকুমড়া ও ২ বিঘায় করলার আবাদ করেছিলেন। এসব সবজির কিছু বিক্রিও করেছিলেন। তবে বন্যায় সবজিখেত ডুবে যাওয়ায় লাভ মেলেনি।

এবার বন্যায় শীতের সবজি আবাদে দেরি হওয়াতেও ক্ষতির মুখে পড়েছেন বলে জানালেন মিরের চর গ্রামের চাষি খোকন মিয়া। তিনি বলেন, ‘সবজির আবাদেই আমাগো আয়–রোজগার। সেই রোজগারেই চলে সংসার। বন্যা ও বৃষ্টির পানি খেত থেইক্যা দেরিতে নামায়, সবজির আবাদও দেরি হইচে। গত বছর শীতের শুরুতে সবজির দাম ভালো আছিল। দেরি হওয়াতে এবার সবজির দামও কমেছে।’