সিলেটে পাহাড়-টিলা কাটা চলছে
শাহ আরেফিন টিলা (শারফিন টিলা)। সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় খাস খতিয়ানের প্রায় ১৩৭ একর জায়গার এই টিলার নিচে রয়েছে বড় বড় পাথরখণ্ড। অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করতে টিলা কাটা চলছিল ২০০৮ সাল থেকে। নয় বছরের মাথায় এই টিলা পুরোটাই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। গত ২৩ জানুয়ারি প্রথম দফায় টিলার মাটি ধসে নিহত হন পাঁচজন পাথরশ্রমিক। ১১ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় দফা টিলাধসে একজন ও ২ মার্চ আরও একজন শ্রমিক নিহত হলে প্রশাসনের টনক নড়ে। এরপর টিলাটি সিলগালা করে রাখা হয়।
এভাবে শুধু শাহ আরেফিন টিলা নয়, সিলেটে সরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন টিলা কাটা চললেও প্রশাসনিক নজরদারি নেই। গত প্রায় এক যুগে সিলেটে পাহাড় ও টিলাধসে ৩৭ জনের মৃত্যুর খবর বিভিন্ন মাধ্যম থেকে সংগৃহীত হলেও এ-সংক্রান্ত কোনো পরিসংখ্যান নেই প্রশাসনিক দপ্তরে। পাহাড়-টিলা কেটে নিশ্চিহ্ন করা বা ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করে ঝুঁকি এড়ানোর ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো ধারাবাহিক উদ্যোগ নেই।
সম্প্রতি রাঙামাটিতে পাহাড়ধসে বড় রকমের প্রাণহানির পর সিলেটের জেলা প্রশাসন ঝুঁকি চিহ্নিত পাহাড়-টিলার তালিকা তৈরির কাজে উদ্যোগী হয়েছে। গত এক সপ্তাহে সিলেট শহরসহ পাহাড়-টিলা অধ্যুষিত গোয়াইনঘাটের জাফলং, ফেঞ্চুগঞ্জ, কোম্পানীগঞ্জ, কানাইঘাট, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ ও জৈন্তাপুর এলাকায় সতর্কতামূলক প্রচারণাও চালানো হচ্ছে।
ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়-টিলার তথ্য পরিবেশ অধিদপ্তরেও নেই। গত রোববার পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেট অঞ্চলের পরিচালক মো. ছালেহ উদ্দীন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, পাহাড় ও টিলাধসের সম্ভাব্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার তালিকা তৈরির কাজ জেলা প্রশাসনের। তবে কোথাও কোনো পাহাড় কাটার খবর পেলে পরিবেশ অধিদপ্তর তা প্রতিরোধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির সুবিধা কাজে লাগিয়ে কেউ যেন পাহাড়-টিলা কাটতে না পারে, সে জন্য কড়া নজরদারি আছে।
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট পাহাড়-টিলা অধ্যুষিত একটি জেলা। নগরের উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিম চা-বাগানবেষ্টিত হওয়ায় ছোট-বড় অসংখ্য টিলার অবস্থান। নগরে আবাসন, সরকারি উন্নয়ন, রাস্তাঘাট করা এবং নগরের বাইরে পাথরখণ্ডের পাহাড়গুলো কাটা হচ্ছে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনে। ব্যক্তিমালিকানাধীন থেকে শুরু করে সরকারি জায়গায় থাকা এসব টিলার অস্তিত্ব প্রায় নিশ্চিহ্ন।
পরিবেশ অধিদপ্তর, পরিবেশবাদী সংগঠনের হিসাবে সিলেট নগরসহ জেলার গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, কানাইঘাট, গোলাপগঞ্জ, জৈন্তাপুর উপজেলায় পাহাড় ও টিলার সংখ্যা ছিল ৪১২। এর মধ্যে টিলা কেটে নিশ্চিহ্ন হয়েছে ৬১টি। ৩৫১টির মধ্যে অর্ধেকের বেশি টিলা আছে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থান নিয়ে। এগুলোর মধ্যে অন্তত ৫০টি টিলা এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস রয়েছে।
পরিবেশবাদী সংগঠনের পর্যবেক্ষণ বলছে, ২০০১ সালের দিকে সিলেট নগরায়ণে নতুন করে আবাসন শুরু হয়। টিলা কাটার প্রবণতা শুরু সেই সময় থেকেই। সরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন টিলা কাটা আইনত নিষিদ্ধ হলেও তা মানা হয় না। এই প্রবণতার মধ্যে পাহাড় ও টিলাধসে দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনাও ঘটে।
এ বছরের ২৩ জানুয়ারি থেকে ২ মার্চ পর্যন্ত শাহ আরেফিন টিলায় তিন দফা ধসে সাতজন শ্রমিক নিহত হন। এর আগে ২০১৪ সালে নগরের লাক্কাতুরা টিলা এলাকায় সিলেট বিভাগীয় স্টেডিয়ামের সীমানাপ্রাচীর ধসে একই পরিবারের তিনজন নিহত হন। ২০০২ সালে নগরের শাহি ঈদগাহ এলাকায় চারজন, ২০০৫ সালে গোলাপগঞ্জে একই পরিবারের তিনজন, ২০০৯ সালে চা-বাগানে টিলাধসে মারা যান তিনজন। ওই বছরের ১০ অক্টোবর গোলাপগঞ্জের কানিশাইলে টিলাধসে এক শ্রমিক এবং ২০১১ সালের ২০ এপ্রিল শহরতলির খাদিমনগরে টিলাধসে মারা যান আরও একজন।
গত পাঁচ বছরে সিলেটে পরিবেশ অধিদপ্তর অভিযানের মাধ্যমে জরিমানা আদায় করে ২৭টি টিলা কাটার ঘটনায়। প্রথম আলোয় প্রকাশিত সচিত্র প্রতিবেদনের সূত্র ধরে এসব অভিযান হয়। এর মধ্যে ২০১২ সালের অভিযানে সর্বোচ্চ ১৮ লাখ টাকার মতো জরিমানা আদায় করা হয়। সর্বশেষ গত বছরের ২৪ মে প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘সিলেটে টিলাখেকো ঘর’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনের সূত্র ধরে পরিবেশ অধিদপ্তর অভিযান পরিচালনা করে। এরপর আর অভিযান হয়নি।
পরিবেশ অধিদপ্তরের অভিযানের বাইরে জেলা প্রশাসন গত ১০ মে নগরের আখালিয়া এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানের মাধ্যমে টিলা কাটার দায়ে এক যুক্তরাজ্যপ্রবাসীর কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করেন। ১২ জুন কানাইঘাটে টিলা কেটে ঝুঁকিপূর্ণভাবে পাথর উত্তোলন করায় ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা ও ৫০ হাজার ঘনফুট পাথর জব্দ করেন।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), সিলেটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সিলেট নগর ও আশপাশ এলাকায় প্রায় ২৫০টি পাহাড়-টিলায় ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস রয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন উপজেলায় রয়েছে আরও শতাধিক পাহাড়-টিলায় ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস। শহরতলির বালুচর এলাকায় ৫১টি টিলার পাদদেশে ২ হাজার পরিবার বাস করছে। আধা পাকা বাড়ি, কাঁচা বাড়ি করে আরও প্রায় ৭-৮ হাজার পরিবার বসবাস করছে।
সরেজমিনে শহরতলির বালুচর, খাদিম ও নগরের আখালিয়া এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, একেকটি টিলার পাদদেশে ২০ থেকে ১০০ পরিবার বসবাস করছে। আখালিয়ার যুগীটিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে প্রায় ৫০টি পরিবার। একইভাবে খাদিমপাড়া, খাদিমনগর, ইসলামপুর মেজরটিলা, মংলিরপাড়, হাওলাদারপাড়া, দলদলি চা-বাগান, আলীবাহার, আলুরতল এলাকার বিভিন্ন পাহাড়-টিলার পাশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস করে আসছে লোকজন।
পাহাড়-টিলা অধ্যুষিত সিলেট জেলায় ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসের সঠিক পরিসংখ্যান জেলা প্রশাসনের কাছে না থাকা বিস্ময়কর বলে মন্তব্য করেন বাপা সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম চৌধুরী। তিনি বলেন, শাহ আরেফিন টিলায় প্রাণহানি না ঘটলে হয়তো টিলা সাবাড় হয়ে যেত।
জেলা প্রশাসক মো. রাহাত আনোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, পাহাড় ও টিলাধসের সম্ভাব্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার তালিকা তৈরির কাজ করছেন সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও)। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উপজেলাগুলোতে এ রকম ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়-টিলার আশপাশের এলাকার মানুষকে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে অতিবৃষ্টির কারণে পাহাড় ও টিলাধসের ঘটনা ঘটে থাকে, তাই এই মৌসুম সামনে রেখেই জেলা প্রশাসন দুর্ঘটনা এড়াতে সব ধরনের তৎপরতা চালাচ্ছে।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুর ও পরিবেশ কৌশল বিভাগের অধ্যাপক মুশতাক আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, একটি টিলা সাবাড় করার প্রথম কৌশল হিসেবে দেখা যায় যত্রতত্র বসবাস। পরে বসবাসকারীদের নিরাপত্তার অজুহাত নিয়ে টিলা কাটা হয়। পাহাড়-টিলা রক্ষার স্বার্থে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি অপসারণ করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।