সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি, ত্রাণের জন্য আকুতি

সুরমা নদীর পানি উপচে কালীঘাট এলাকার বেশ কয়েকটি দোকানে প্রবেশ করেছে। এতে দোকানপাট বন্ধ রয়েছে
ছবি: প্রথম আলো

সিলেটের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। আট দিন ধরে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সিলেট নগরসহ জেলার ১৩টি উপজেলায় প্লাবিত হওয়া হাজার হাজার গ্রামে এখনো পানি কমছে না। এতে অনেকে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন, অন্যদিকে ঘরে মজুত করা খাবারও শেষ হয়ে গেছে। বন্যাদুর্গত মানুষ পর্যাপ্ত ত্রাণ পাচ্ছে না বলেও অনেকে অভিযোগ করেছেন।

গতকাল বুধবার রাতে ভারী বৃষ্টিপাত হওয়ায় নদ-নদীর পানি কিছুটা বৃদ্ধি পাওয়ায় আজ বৃহস্পতিবার ভোর থেকে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সিলেটে কমপক্ষে ১০ থেকে ১২ লাখ মানুষ পানিবন্দী আছেন। বানভাসি মানুষের অভিযোগ, অনেক ঘরবাড়িতে এখনো বুক ও গলাসমান পানি। অনেকে নিজের বাড়িঘর ছেড়ে নিরাপদে আশ্রয় নিয়েছেন। কেউ কেউ ঘরের ভেতরে মাচা বানিয়ে থাকছেন।

একাধিক বানভাসি মানুষ বলেন, চাল, ডাল ও তেল না থাকায় অনেকের বাড়িতে রান্না বন্ধ হয়ে আছে। ইঞ্জিন নৌকার শব্দ শুনলেই তাঁরা ত্রাণের আশায় ছুটে আসছেন। বন্যাকবলিত এলাকার মানুষ পানিবাহিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। সাপ, পোকামাকড় ও জোঁকের উপদ্রব বেড়েছে। শৌচাগার ডুবে যাওয়ায়ও চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। সরকারিভাবে ত্রাণ দেওয়ার কথা বলা হলেও অনেকে ত্রাণ পায়নি। উপজেলা সদরের সঙ্গে অধিকাংশ এলাকার মানুষের সড়কপথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে মানুষ নৌকা ও কলাগাছ দিয়ে তৈরি ভেলা ব্যবহার করছে।

সিলেট নগরের মণিপুরি রাজবাড়ি এলাকার বাসিন্দা দেবব্রত চৌধুরী বলেন, তিন দিন ধরে তাঁর বাড়িতে পানি উঠেছে। তাই বাধ্য হয়ে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তিনি অন্যত্র সরে গিয়েছেন। বন্যার পানিতে তাঁর বাড়ির প্রচুর জিনিসপত্র বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সিলেট কার্যালয় জানিয়েছে, আজ বৃহস্পতিবার সকাল ছয়টার দিকে সিলেটের সুরমা নদীর দুটি পয়েন্ট এবং কুশিয়ারা নদীর একটি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।

সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. আনোয়ার সাদাত প্রথম আলোকে বলেন, সিলেটে পর্যাপ্ত পরিমাণে ত্রাণসামগ্রী বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা প্লাবিত এলাকায় ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছেন। এ ছাড়া জেলা প্রশাসন সার্বক্ষণিক প্লাবিত এলাকা পর্যবেক্ষণ করছে। গতকাল রাতের বৃষ্টিপাতের কারণে আজ সকালের পর থেকে পানি কিছুটা বেড়েছে বলেও জানান তিনি।

১৩ দিন পর দেশে ফিরেই নগরের বন্যাকবলিত বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী
ছবি: আনিস মাহমুদ

দেশে ফিরে বন্যার্ত মানুষের পাশে মেয়র

সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী ১৩ দিনের সফর শেষে যুক্তরাজ্য থেকে দেশে ফিরেছেন। আজ বৃহস্পতিবার সকাল সোয়া ১০টার দিকে তিনি বিমানবন্দরে নেমে প্রথমে বাসায় যান। এর ঘণ্টাখানেক পর তিনি নগরের বন্যাকবলিত মানুষের খোঁজখবর নিতে যান। সেখানে গিয়ে বন্যার্ত মানুষের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়ে মেয়র বলেন, সুরমা নদীর খনন ছাড়া কোনোভাবেই বন্যা পরিস্থিতি ঠেকানোর সুযোগ নেই।

বেলা সোয়া ১১টার দিকে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী নগরের বন্যাকবলিত তেরোরতন এলাকায় যান। এরপর উপশহর ও সোবহানীঘাটসহ নগরের বিভিন্ন এলাকা তাঁর পরিদর্শন করার কথা রয়েছে। বন্যার্ত মানুষের সঙ্গে আলাপকালে মেয়র বলেন, সিটি করপোরেশন নগরবাসীর পাশে আছে। প্লাবিত এলাকার লোকজনের জন্য খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দূর করতে তারা কাজ করছে। পানি না নামা পর্যন্ত দুর্ভোগ কমাতে তিনি নগরবাসীর পাশে দিনরাত থাকবেন বলে আশ্বাস দেন। পাশাপাশি দুর্যোগময় এই পরিস্থিতিতে বিত্তশালীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান মেয়র।

মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি যুক্তরাজ্যে ছিলাম। সফর সংক্ষিপ্ত করে সিলেটে ফিরেই নগরের পানিবন্দী মানুষের পাশে ছুটে এসেছি। বিপাকে পড়া মানুষজন যেন খাবার ও পানির সংকটে না পড়েন, সেটিই আমরা গুরুত্বের সঙ্গে খেয়াল রাখছি। এ ছাড়া যেন পানিবাহিত রোগ না ছড়ায়, সে জন্য চিকিৎসক দল কাজ করছে। নগরে একাধিক আশ্রয়কেন্দ্র চালু হয়েছে, প্রয়োজন হলে বাসা ভাড়া নিয়ে হলেও প্লাবিত মানুষদের থাকার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

মেয়র আরও বলেন, অব্যাহতভাবে পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টি হলে সুরমা নদীর খনন ছাড়া কোনোভাবেই সিলেট নগরের বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। দীর্ঘদিন ধরেই নদী খননের বিষয়টি বলা হচ্ছে। কারণ, সুরমা নদী পানির ধারণক্ষমতা হারিয়েছে। খনন হলে মানুষের এই ভোগান্তি হতো না। অথচ পার্শ্ববর্তী মৌলভীবাজার জেলার মনু নদী খনন হওয়ায় মৌলভীবাজার শহর বন্যামুক্ত হয়েছে। সুরমা নদী খনন করা হলে সিলেট শহরও বন্যামুক্ত থাকবে।