সীতাকুণ্ডে বাস আটকে দিচ্ছে পুলিশ, দুর্ভোগে যাত্রীরা

গাছতলায় বসে আছেন গাইবান্ধার দুই পরিবারের চারজন। রোববার দুপুরে তাঁদের বাসটি হাইওয়ে পুলিশ আটকে দেওয়ার পর থেকে তাঁরা এই গাছতলায় আছেন। বারো আউলিয়া হাইওয়ে থানা এলাকা, সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম, ১৭ মে দুপুর
ছবি: প্রথম আলো

৭০ বছরের বৃদ্ধ আবদুর ছাত্তার ও অসুস্থ রাজা মিয়া (৫০) যাত্রীবাহী বাসে করে পরিবার নিয়ে যাচ্ছিলেন গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে। দুজনেই শুঁটকির ব্যবসা করতেন চট্টগ্রাম নগরের ষোলশহর এলাকায়। রোববার অন্য যাত্রীদের মতো তাঁরাও বাসে ওঠেন গাইবান্ধায় যেতে।

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের চেকপোস্টে বারো আউলিয়া হাইওয়ে পুলিশ তাঁদের বাসটি আটক করে। এরপর থেকে বস্তা বিছিয়ে থানা এলাকায় গাছতলায় অবস্থান নেন দুই পরিবারের চার সদস্য। এ গাছতলাতেই তাঁরা রাত যাপন করেন। সোমবার দুপুরেও তাঁদের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে গাছতলায় বিছানো বস্তার ওপর বসে থাকতে দেখা গেছে।

শুধু ছাত্তার ও রাজা নন, গত ২৪ ঘণ্টায় রাজার মতো ৫০টি বাসের যাত্রীই অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়েছেন। দূরের জেলার অনেকেই গন্তব্যে না গিয়ে উল্টো দিকে ফিরেছেন। কাছের জেলার যাত্রীরাও ভেঙে ভেঙে গন্তব্যে রওনা দিয়েছেন।

রাজা বলেন, দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকায় আগের মতো ব্যবসা করতে পারছেন না। তাই বাসা ছেড়ে দিয়েছেন গ্রামে যাওয়ার জন্য। ফলে আর উল্টো ফিরতে পারছেন না। এখন ১৫ হাজার টাকা দিয়ে একটা পিকআপ ঠিক করেছেন গাইবান্ধায় যেতে।

ছাত্তার বলেন, ৪৫০ টাকার ভাড়া ১ হাজার ৭০০ টাকা করে দিয়ে উঠেছিলেন বাসে। রোববার পুলিশ বাসটি আটক করে তাঁদের বিপদে ফেলে।

সরেজমিন দেখা যায়, বারো আউলিয়া হাইওয়ে থানার সামনের মাঠে বাসস্ট্যান্ডের মতো মোট ২৪টি বাস রাখা হয়েছে। থানায় যাওয়ার পথে, থানার পেছনেও খালি জায়গায় আটক করা বাস রাখা হয়। থানা এলাকায় ৩৪টি বাস রয়েছে। আর বাস রাখার জায়গা নেই। যাত্রীবিহীন ছেড়ে আসা তিনটি বাসকে মামলা না দিয়ে হাইওয়ে পুলিশকে ঘুরিয়ে দিতে দেখা গেছে। আটকে রাখা বাসগুলোর ফাঁকে ফাঁকে পরিবহনশ্রমিকদের জটলা দেখা গেছে। কেউ গালগল্প করছেন, আবার কেউ কার্ড খেলছেন।

হাইওয়ে পুলিশ সূত্র জানায়, সীতাকুণ্ডের বারো আউলিয়া হাইওয়ে থানা ও কুমিরা হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির সামনে দুটি চেকপোস্ট রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ৪২টি বাস আটক করেছে হাইওয়ে পুলিশ। এর মধ্যে বারো আউলিয়া হাইওয়ে পুলিশ আটক করেছে ৩৪টি বাস। এ বাসগুলো ছাড়াও ২১টি মাইক্রোবাস ও ছয়টি সিএনজিচালিত অটোরিকশার বিরুদ্ধে মামলা করেছে তারা।

বারো আউলিয়া হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ২৪ ঘণ্টায় আন্তজেলা ৩৪টি বাস আটক ছাড়াও অনেক গাড়ি ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেসব গাড়ি আটক করা হয়েছে, সব গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে।

কুমিরা হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক ফারুক হোসেন বলেন, তাঁরা ২৪ ঘণ্টায় আরও ৮টি বাস আটক করেছেন।

পরিবহনশ্রমিকেরাও দুর্ভোগে
দুই দিন ধরে গাড়ি আটকে থাকায় অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়েছেন পরিবহনশ্রমিকেরাও। অনেকে শ্রমিক চা-বিস্কুট খেয়ে দিনাতিপাত করছেন।

সরেজমিন দেখা যায়, দলে দলে শ্রমিকেরা আড্ডা দিচ্ছেন। কেউ-বা বাসের ফাঁকে ফাঁকে বসে গামছা বিছিয়ে কার্ড খেলে সময় কাটাচ্ছেন। অনেকে তদবির করছেন তাঁদের মামলার কাগজটি যেন তাড়াতাড়ি দিয়ে দেওয়া হয়।

বাঁধন পরিবহনের চালক মো. সুমন, মনিরসহ কয়েকজন পরিবহনশ্রমিক বলেন, গত দেড় মাস গাড়ি বন্ধ। সংসার আর চলছিল না। বাধ্য হয়ে গাড়ি নিয়ে নেমেছেন। রোববার সকালে সোনাপুর থেকে চট্টগ্রামে যেতে কোথাও বাধা পাননি। কিন্তু দুপুরে চট্টগ্রাম থেকে সোনাপুরে যাওয়ার পথেই গাড়ি আটক হয়।

পরিবহনশ্রমিকেরা বলেন, ভাত খাওয়ার টাকা নেই। তাই চা-বিস্কুট খেয়ে দিনাতিপাত করছেন। গাড়ির মামলা দিয়েছে বলে শুনেছেন তাঁরা। কিন্তু কাগজ হাতে পাননি। কাগজ পেলে মালিকের সঙ্গে কথা বলে মামলা ভাঙিয়ে চট্টগ্রামে চলে যাবেন।

পরিবহনশ্রমিকদের অভিযোগ, সরকার বিমাতাসুলভ আচরণ করছে বাসশ্রমিকদের সঙ্গে। পণ্যবাহী পরিবহন চলছে। অথচ তাঁদের সন্তানদের না খেয়ে থাকতে হচ্ছে। তাঁরা শুনেছেন তাঁদের জন্য ২ হাজার ৫০০ টাকা করে সরকার দিয়েছে। কিন্তু তাঁরা পাননি। অথচ অটোচালক, ট্রাকচালক—তাঁরাও পরিবহনশ্রমিক। তাঁদের গাড়ি চললেও তাঁরা ২ হাজার ৫০০ টাকাও পাচ্ছেন।

প্রকৃত বাসশ্রমিকেরা অনুদান পাচ্ছেন না জানিয়ে মোহাম্মদ রফিক নামে পরশুরাম পরিবহনের এক চালক বলেন, তাঁর বাড়ির পাশে কৃষকও পরিবহনশ্রমিকের অনুদান পেয়েছেন। অথচ প্রকৃত বাসশ্রমিকেরা এ অনুদান পাচ্ছেন না।