সেই হাওর-প্রকৃতি নেই

৫০ বছর আগেও হাকালুকি হাওর ছিল। কিন্তু হাওর এখনকার মতো উদাম, বৃক্ষ ও জলজ উদ্ভিদশূন্য ছিল না।

শুকনো মৌসুমে মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওর। সম্প্রতি তোলা
ছবি: প্রথম আলো

মিন্টু বিশ্বাস (৬৫) হাকালুকি হাওরপারের মানুষ। হাওরের প্রাণখোলা হাওয়া, জলরাশি আর জলজবৈচিত্র্যের মধ্যেই তাঁর বেড়ে ওঠা। জীবনযাপন। হাকালুকি হাওরের কোল ঘেঁষে তাঁর গ্রাম মুর্শিবাদকুড়া। গ্রামটি মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার তালিমপুর ইউনিয়নে পড়েছে।

৫০ বছর আগেও এই হাকালুকি হাওর ছিল। কিন্তু হাওর এখনকার মতো উদাম, বৃক্ষ ও জলজ উদ্ভিদশূন্য ছিল না। মাছের আকাল ছিল না। ছিল না হঠাৎ বৃদ্ধি পাওয়া জলের আঘাত। ঘন হিজল-করচের বন ছিল। বিল-বাদাড়ে জলজ উদ্ভিদ ছিল। মাছের প্রাচুর্য ছিল। স্থানীয় ও পরিযায়ী পাখির কলকাকলি ছিল। হাওরপারের মানুষ হাওরের সঙ্গে মিলেমিশে অনেকটাই কম উদ্বেগের একটা জীবন কাটিয়েছে। এই ৫০ বছরে একটা মানুষের চোখের সামনেই বদলে গেছে হাওরটি।

আজ ৫ জুন নানা কর্মসূচিতে পালিত হবে বিশ্ব পরিবেশ দিবস।

গতকাল শনিবার হোমিও চিকিৎসক ও কৃষিপ্রেমী মিন্টু বিশ্বাসের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। এ সময় মিন্টু বিশ্বাস জানিয়েছেন, তাঁদের গ্রাম মুর্শিবাদকুড়া একেবারেই হাওরের বুকের কাছেই। গ্রামের দক্ষিণে পুরোটাই হাকালুকি হাওর। ওখানেই তাঁর জন্ম। তিনি শৈশব-কৈশোরে যে হাওরকে দেখেছেন। জীবনের প্রান্তে এসে সেই হাওর-প্রকৃতি নেই। হাওরকেন্দ্রিক মানুষের জীবন-জীবিকার তাগিদে হাওরের সঙ্গে মাছ ধরা, কৃষিসহ যে মমত্বমাখা প্রয়োজনীয় অংশগ্রহণ ছিল, ধীরে ধীরে সেই মমত্বে ক্ষয় ধরেছে। যা হাওরটাকে বদলে দিয়েছে।

হাওরের বিভিন্ন এলাকায় অনেক জঙ্গল ছিল। শীতকালে এসব জঙ্গলে মেছো বাঘ (মেছো বিড়াল), সাপসহ অনেক বন্য প্রাণী দেখা গেছে। এসব গাছ আগেও কিছুটা কাটা হয়েছে। সাফ করে কেউ কাটেনি। মুক্তিযুদ্ধের পর গাছ কাটার গতি বেড়েছে। কিছু হাওরপারের মানুষ কেটেছেন। ইজারাদারেরা বছর বছর গাছ কেটে বিলে কাঁটা দিয়েছেন। এখন হাওর একদম পরিষ্কার। গাছপালার কারণে বর্ষায় গ্রামের বাড়িগুলোতে ‘আফাল (ঢেউ)’ এসে আঘাত করত না। এখন বাতাস দিলেই বাড়িঘরে আফাল আছড়ে পড়ে। হাল্লা, দশঘরিসহ অনেক গ্রামের মানুষ আফালের ক্ষয়ক্ষতি পোষাতে না পেরে গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র সরে গেছেন। হাওরের বিলগুলোতে ওকল (মাখনা), পদ্ম, শাপলা, সিংরাইসহ অনেক রকম জলজ উদ্ভিদ ছিল।

জলজ উদ্ভিদের ফল ছিল হাওরপারের মানুষের কাছে পছন্দের। জলজ উদ্ভিদ ছিল মাছের নিরাপত্তার চাদর। জলজ উদ্ভিদের কারণে ইচ্ছে করলেই কেউ জাল দিয়ে সব মাছ ধরতে পারতেন না। প্রাকৃতিক নিয়েমেই মাছ ডিম ছেড়েছে। বড় হয়েছে। হাওরে প্রচুর মাছ ছিল। রুই, কাতলা, মৃগেল, পাঙাশ, বোয়ালসহ নানা জাতের বিশাল সব মাছ ধরা পড়ত। পোনা মাছ সাধারণত কেউ ধরতেন না। মাছের অভাব কেউ বোধ করেননি। এখন কারেন্ট ও টানা জাল দিয়ে, বিল সেচে শেষ মাছ ধরা হচ্ছে। মাছের আকাল তৈরি হয়েছে।

শীতকালে পাখি আসত হাওরে, হাওরপারের গ্রামে। রাত ভোর হওয়ার আগে থেকেই পাখিদের ডাকাডাকিতে মানুষের ঘুম ভেঙেছে। তখনো কিছু মানুষ জাল দিয়ে পাখি শিকার করেছে। কিন্তু তা ছিল একেবারেই কম। এখনকার মতো বিষটোপ দিয়ে কেউ হাজার পাখি হত্যা করত না।

হাওরপারের মানুষ বোনা আমন (কাতারি) ও আউশ ধান চাষ করতেন। আকস্মিক বন্যায় খুব একটা ফসল তলিয়ে যেত না। এখন বোনা আমনের আবাদ প্রায় হয়ই না। মানুষ বোরো ফসলের আবাদ করে। কিন্তু সব সময় উদ্বেগে থাকে। বৃষ্টি না হলে ধান ফলে না। হঠাৎ ঢল এসে সবকিছু তলিয়ে নেয়। তাঁর এক জীবনে চোখের সামনেই হাকালুকি হাওরের এই পরিবর্তন এসেছে।

দেশের সবচেয়ে বড় হাওর, মিঠাপানির জলাভূমি এই হাকালুকি হাওর। এর বিস্তৃতি মৌলভীবাজারের বড়লেখা, জুড়ী ও কুলাউড়া এবং সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজারজুড়ে। হাকালুকি হাওর এখন পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা।

মিন্টু বিশ্বাস গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘চোখের সামনেই হাওরের প্রকৃতির বদল দেখেছি। একমাত্র হাওরপারের মানুষ হাওরকে ধ্বংস করেনি। ওপর থেকে সবকিছু পরিচালনা করা হচ্ছে। ব্যবহৃত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। ওপর থেকে ঠিক না হলে এই ধ্বংসের ধারা বন্ধ হবে না। হাওরের যতটুকু পরিবেশ আছে, তা–ও রক্ষা করা যাবে না।’