সেচ খরচ অর্ধেক, কমে লবণাক্ততা

মালচিং পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করছে খুলনা মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউটের লবণাক্ততা ব্যবস্থাপনা ও গবেষণা কেন্দ্র।

বটিয়াঘাটার ঘাগরামারীর বিলে মালচিং পদ্ধতিতে চাষ করা তরমুজের খেত। সাম্প্রতিক ছবি
প্রথম আলো

খুলনার উপকূলীয় এলাকায় ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে তরমুজ চাষ। কিন্তু লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও সেচের অভাবে চাষাবাদ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তবে এসব সমস্যা সমাধানে কৃষকদের পথ দেখাচ্ছে মালচিং পদ্ধতি। এতে জমির লবণাক্ততা ও পানির ব্যবহার অর্ধেক কমিয়ে আনা সম্ভব বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।

মালচিং পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করছে খুলনা মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউটের লবণাক্ততা ব্যবস্থাপনা ও গবেষণা কেন্দ্র। ইতিমধ্যে মিষ্টিকুমড়া চাষে সফল হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রথমবারের মতো প্রতিষ্ঠানটির সহায়তায় বটিয়াঘাটা উপজেলার এক কৃষক ওই পদ্ধতিতে তরমুজ চাষ করছেন।

ওই কৃষকের নাম তারেক মাহমুদ (২৮)। তিনি দীর্ঘদিন সিঙ্গাপুরে ছিলেন। তিন বছর আগে দেশে ফিরে চাষাবাদ শুরু করেন। বটিয়াঘাটায় অবস্থিত লবণাক্ততা ব্যবস্থাপনা ও গবেষণা কেন্দ্রের পাশে ঘাগড়ামারী বিলে সাড়ে চার বিঘা জমিতে মালচিং পদ্ধতিতে তরমুজ চাষ করছেন তিনি। আর পাশের দেড় বিঘা জমিতে চাষ করছেন মালচিং ছাড়াই।

গত বুধবার দুপুরে তারেক মাহমুদের তরমুজখেতে গিয়ে দেখা যায়, মালচিং ছাড়া যে দেড় বিঘা জমি রয়েছে, তাতে সেচ দেওয়ায় ব্যস্ত তিনি। তাঁর সঙ্গে কাজ করছেন দুজন শ্রমিক। ওই বিলে যত দূর চোখ যায়, তত দূরই তরমুজের খেত। তারেক মাহমুদের মতো সবাই ব্যস্ত সেচ নিয়ে। তবে পুরো বিলের মধ্যে মালচিং দেওয়া সাড়ে চার বিঘা জমির তরমুজগাছ সবচেয়ে সতেজ ও বড়।

তারেক মাহমুদ বলেন, দেশে ফেরার পর প্রতিবছর তরমুজ মৌসুমে জমি ইজারা নিয়ে তরমুজ চাষ করছেন তিনি। তবে এবার চাষ মৌসুম শুরু হওয়ার আগে লবণাক্ততা ব্যবস্থাপনা ও গবেষণা কেন্দ্রে গিয়ে দেখতে পান, প্রতিষ্ঠানটি মালচিং পদ্ধতিতে মিষ্টিকুমড়ার চাষ করেছে। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে ওই পদ্ধতিতে চাষ করার সুবিধাগুলো জেনে নেন তিনি। পরে সাড়ে চার বিঘা জমিতে ওই পদ্ধতিতে তরমুজ চাষ করছেন।

মালচিং পদ্ধতিতে মাটিতে পচনশীল একধরনের পলিথিন দিয়ে চাষের মাদাটি (বেড) ঢেকে দেওয়া। আর মালচিং কাগজ হলো প্লাস্টিকের মতো একধরনের কাগজ, যার এক পাশে কালো ও অন্য পাশে রুপালি রং করা থাকে। কালো পাশ নিচে ও রুপালি পাশ ওপরের দিকে দিয়ে মাদাটি ঢেকে দিতে হয়। এভাবে মাটি ঢেকে দেওয়ার ফলে কালো রঙের প্রভাবে প্রচণ্ড সূর্যের তাপেও মাটির আর্দ্রতা শুকিয়ে যেতে পারে না। এ কারণে মাটিতে পানির পরিমাণ কম লাগে। অন্যদিকে মাটি ঢেকে থাকায় আগাছাও হয় না। এ ছাড়া রুপালি পাশ ওপরে থাকায় পোকামাকড়ের উপদ্রবও তুলনামূলক অনেক কম হয়।

তারেক মাহমুদ জানান, তরমুজের চারা রোপণ করে একবার ও ১৯ দিন পর আরেকবার পানি দিয়েছিলেন। বর্তমানে ওই চারার বয়স প্রায় দেড় মাস। ওই জমিতে তেমন নজর দেওয়ারই প্রয়োজন হয় না। জমিতে কোনো আগাছা ও পোকামাকড়ের আক্রমণ হয়নি। তবে মালচিং ছাড়া যে দেড় বিঘা জমি চাষ করছেন, সেখানে সপ্তাহে একবার পানি দিতে হচ্ছে। ভাইরাসের সংক্রমণ হওয়ায় ৬০০টির মতো চারা উপড়ে ফেলতে হয়েছে। তিনি আশা করছেন, মালচিং পদ্ধতিতে চাষ করা জমি থেকে ভালো ফলন পাবেন।

লবণাক্ততা ব্যবস্থাপনা ও গবেষণা কেন্দ্রটি বিভিন্ন ধরনের সবজি ও শস্য উৎপাদন নিয়ে গবেষণা করে। ওই প্রতিষ্ঠানের ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, এক পাশে প্রায় ১০ কাঠা জমিতে মিষ্টিকুমড়ার গবেষণা প্লট তৈরি করা হয়েছে। নয়টি গবেষণা প্লটের তিনটিতে মালচিং কাগজ, তিনটিতে খড়ের মালচিং ও তিনটি প্লট সাধারণভাবে চাষ করা হয়েছে। যে তিনটি প্লটে মালচিং কাগজ ব্যবহার করা হয়েছে, তার গাছগুলো বেশ তরতাজা।

ওই কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অমরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস বলেন, সাধারণ প্লটে লবণাক্ততার পরিমাণ প্রতি মিটারে ৮ থেকে ১০ ডেসি সিমেন (ডিএস)। মালচিং কাগজ দিয়ে মোড়ানো প্লটে যা মাত্র ৩ থেকে ৪ ডিএস। আর খড়ের প্লটে ৬ থেকে ৭ ডিএস। মালচিং কাগজে মোড়ানো প্লটে মাটির আর্দ্রতা তুলনামূলক অনেক বেশি।

অমরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস আরও বলেন, প্রাথমিক গবেষণায় ভালো ফলাফল পাওয়া গেছে। তরমুজ চাষে প্রচুর মিঠাপানির প্রয়োজন হয়। কিন্তু খুলনার উপকূল এলাকায় মিঠাপানির খুব অভাব। সে ক্ষেত্রে এ পদ্ধতিতে তরমুজ চাষ করলে কম সেচে ভালো ফলন পাওয়া যেতে পারে।

খুলনা মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও গোপালগঞ্জ-খুলনা-বাগেরহাট-সাতক্ষীরা-পিরোজপুর কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প পরিচালক শচীন্দ্র নাথ বিশ্বাস বলেন, বছর শেষে প্রাপ্ত ফলাফল মূল্যায়ন করে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের মাধ্যমে পদ্ধতিটি মাঠ পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। এটি দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ত এলাকার কৃষিতে বিপ্লব আনতে পারে।