সেচযন্ত্রে ভর করেছে পাউবো

ভুক্তভোগীরা বলছেন, সমস্যা জিইয়ে রেখে স্থায়ী ব্যবসার ফাঁদ তৈরি করাই এই সেচযন্ত্র তত্ত্বের উদ্দেশ্য

জলাবদ্ধতা দূরীকরণে সেচযন্ত্র দিয়ে পানি সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। সম্প্রতি যশোরের অভয়নগর উপজেলার ভবানীপুর এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

বিলে থই থই করছে পানি। কোথাও কোমরসমান, আবার কোথাও বুকসমান। তবে বিলসংলগ্ন নদী প্রায় শুকিয়ে গেছে। সরু খালের মতো নদীর কোনো কোনো অংশে চিরচিরে পানি। এই নদী দিয়ে আসা বিলের পানি সেচযন্ত্র দিয়ে যশোরের ভবদহ অঞ্চলের জলাবদ্ধতা দূর করতে নেমেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। আর এ কাজে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে সহযোগিতা করছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)।

তাদের দাবি, সেচযন্ত্র দিয়ে সেচে গত প্রায় আড়াই মাসে ভবদহ অঞ্চলের প্রায় দেড় থেকে তিন ফুট পানি কমেছে।

ভবদহ অঞ্চলের ভুক্তভোগী মানুষ এবং জলাবদ্ধতার নিরসনে আন্দোলনরত সংগঠনগুলোর নেতারা বলছেন, সেচপাম্প বসিয়ে পানি সেচে ভবদহ জলাবদ্ধতার সমাধান মোটেও বাস্তবসম্মত নয়। এতে রাষ্ট্রের অর্থ অপচয় হচ্ছে। বিল কপালিয়ায় টিআরএম (টাইডল রিভার ম্যানেজমেন্ট—জোয়ারাধার) হতে না দেওয়া এবং সমস্যা জিইয়ে রেখে স্থায়ী ব্যবসার ফাঁদ তৈরি করাই এই সেচযন্ত্র তত্ত্বের উদ্দেশ্য।

মূল নদীসংলগ্ন যেকোনো একটি নির্বাচিত বিলের তিন দিকে পেরিফেরিয়াল বাঁধ নির্মাণ করে অবশিষ্ট দিকের বেড়িবাঁধের একটি অংশ উন্মুক্ত করে বিলে জোয়ারভাটা চালু করা হয়। এটাই টিআরএম নামে পরিচিত। এই পদ্ধতিতে সাগর থেকে জোয়ারের সঙ্গে আসা পলি পর্যায়ক্রমে এলাকার একটি করে বিলে ফেলে বিল উঁচু করার পাশাপাশি নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি হয়। এতে নদী দিয়ে পানি নিষ্কাশিত হওয়ায় কোনো জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় না।

যশোরের অভয়নগর, মনিরামপুর ও কেশবপুর উপজেলা এবং খুলনার ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলার অংশবিশেষ নিয়ে ভবদহ অঞ্চল। এলাকার ৫২টি বিলের পানি ওঠানামা করে মুক্তেশ্বরী, টেকা, হরি ও শ্রী নদী দিয়ে। পলি পড়ে নদীগুলো নাব্যতা হারিয়েছে। ফলে নদী দিয়ে পানি নিষ্কাশিত হচ্ছে না। এ অবস্থায় বৃষ্টির পানিতে এলাকার বিলগুলো প্লাবিত হয়। বিল উপচে পানি ঢোকে বিলসংলগ্ন গ্রামগুলোতে। গত বর্ষা মৌসুমে অভয়নগর ও মনিরামপুর উপজেলার শতাধিক গ্রাম পানিতে তলিয়ে যায়। অসংখ্য বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, মাছের ঘের, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান চলে যায় পানির নিচে। অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হন এলাকার প্রায় দুই লাখ মানুষ।

এ অবস্থায় গত ১৬ অক্টোবর ভবদহ পরিদর্শনে এসে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব কবির বিন আনোয়ার টিআরএম না করার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। ভবদহ জলাবদ্ধতার নিরসনে তিনি সেচযন্ত্র দিয়ে পানি সেচ এবং নদী কাটার বিষয়ে মতামত দেন। পরে গত ১৬ জানুয়ারি থেকে শুরু হয় সেচযন্ত্র দিয়ে পানি সেচের কাজ।

গত ২৫ মার্চ গিয়ে দেখা যায়, বিলসংলগ্ন মুক্তেশ্বরী, টেকা, হরি ও শ্রী নদী শুকিয়ে সরু খালের মতো হয়ে আছে। নদীর কোনো কোনো অংশে অল্প পানি। ভবদহ স্লুইসগেটের (২১ ভেন্ট) ওপর ১৪টি বৈদ্যুতিক সেচযন্ত্র বসানো আছে। এর মধ্যে ৬টি সেচযন্ত্র দিয়ে স্লুইসগেটের এক পাশের নদী থেকে পানি সেচে পাইপের মাধ্যমে অপর পাশে নদীতে ফেলা হচ্ছে। স্লুইসগেটের সামনে শ্রী নদীতে অল্প পানি। ৯ ভেন্ট স্লুইসগেটের ওপর ৬টি বৈদ্যুতিক সেচযন্ত্র বসানো রয়েছে। কিন্তু সেগুলোতে বৈদ্যুতিক সংযোগ দেওয়া হয়নি। ২১ ভেন্ট স্লুইসগেটের পশ্চিম দিকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে কালীতলা এলাকায় একটি এবং তার উত্তর দিকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে আরেকটি এক্সকাভেটর দিয়ে নদীর মধ্যে নালা কাটা হচ্ছে।

এ ব্যাপারে ভবদহ পানিনিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির উপদেষ্টা ইকবাল কবির বলেন, ৮০৮ কোটি টাকার যে প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে তাতে এলাকার ভুক্তভোগী মানুষের মতামত গ্রহণ করা হয়নি। টিআরএম না করে বিএডিসি ও পানি উন্নয়ন বোর্ড সেচযন্ত্র দিয়ে পানি সেচে ভবদহ জলাবদ্ধতার সমাধান করতে চায়। এটা অবাস্তব এবং এতে রাষ্ট্রের অর্থ অপচয় হচ্ছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড, যশোর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী তাওহীদুল ইসলাম বলেন, ‘জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি থেকে পরীক্ষামূলকভাবে বিএডিসির সহযোগিতায় আমরা সেচযন্ত্র দিয়ে সেচ শুরু করেছি। এতে ৬০ লাখ টাকা ব্যয় হবে। প্রতিদিন ছয়-সাতটা সেচযন্ত্র চলছে। ইতিমধ্যে প্রায় ৩ ফুট পানি কমে গেছে। এর মধ্যে রোদেও কিছু পানি কমেছে। আগামী ১৫-২০ দিন পর বিষয়টি স্পষ্ট বোঝা যাবে।’

তাওহীদুল ইসলাম বলেন, নদীতে পানি কম। ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে দুটি এক্সকাভেটর দিয়ে ৩ দশমিক ৭৬ কিলোমিটার নদীতে পাইলট চ্যানেল কাটার কাজ চলছে। চ্যানেল কাটা শেষ হলে পানির প্রবাহ বাড়বে। এতে সব কটি সেচযন্ত্র চলবে এবং দ্রুত পানি কমে যাবে।