সেবা দিয়ে গর্বিত দুই বোন

মুক্তিযোদ্ধা দুই বোন গতকাল একাত্তরের স্মৃতিচারণা করেন। বিকেলে কুষ্টিয়া পৌরসভার বিজয় উল্লাস চত্বরে
ছবি: প্রথম আলো

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিবারের সঙ্গে তাঁরা দুই বোন পশ্চিমবঙ্গের নদীয়ায় পাড়ি জমান। উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার সময়ই তাঁরা নার্সিং ইনস্টিটিউটে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। সেই শিক্ষা কাজে লাগিয়ে কৃষ্ণনগরের শক্তিনগর জেনারেল হাসপাতালে শরণার্থী ও আহত মুক্তিযোদ্ধাদের তাঁরা সেবা দেন। এই দুই বোন হলেন লুলু ই ফেরদৌস ও লুলু ই জান্নাত। দেশের জন্য কাজ করতে পেরে গর্বিত দুই বোন স্বাধীনতার ৫০ বছরে সেসব দিনের স্মৃতিচারণা করলেন।

কুষ্টিয়া শহরের থানাপাড়া এলাকার বাসিন্দা শুকুর উদ্দিনের মেয়ে ফেরদৌস ও জান্নাত। ১৯৭০ সালে কুষ্টিয়া শহরের চাঁদ সুলতানা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন তাঁরা। তখন তাঁদের বয়স ছিল যথাক্রমে ১৬ ও ১৫ বছর। এসএসসি পাসের পর নার্সিং ইনস্টিটিউটে দুই বোন তিন মাসের প্রশিক্ষণ নেন। একাত্তর সালের মার্চে দেশের পরিস্থিতি অশান্ত হতে থাকে। তখন তাঁরা শহরের কোর্টপাড়ায় থাকতেন। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে শহরের পাশে লাহিনীপাড়ায় দাদাবাড়িতে চলে যান তাঁরা। ৬ এপ্রিল সীমান্ত পেরিয়ে চলে যান ভারতের শিকারপুরে।

ফেরদৌস ও জান্নাত করিমপুরে একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কাজ শুরু করেন। দুই মাস পর মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের ভিড় বেড়ে যাওয়ায় তাঁরা কৃষ্ণনগরের শক্তিনগর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চলে যান।

মে মাসের শেষ দিকে শরণার্থীশিবিরে কলেরা দেখা দেয়। প্রতিদিন রোগী বাড়তে থাকে। একসময় ভয়াবহ আকার ধারণ করে কলেরা। এর মধ্যেই আহত মুক্তিযোদ্ধারা আসা শুরু করেন। দুই বোনের কাজের চাপ বেড়ে যায়। শক্তিনগর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তাঁরা দুজন বাংলাদেশি নার্স ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন ভারতের দুজন জ্যেষ্ঠ নার্স।

লুলু ই জান্নাত বলেন, ‘দুই বোন প্রতিদিন বেতন পেতাম ১৬ টাকা। সেই টাকা দিয়ে মা-বাবাসহ ৯ ভাইবোনের সংসার চলত। ভাড়া বাসায় থাকতাম। এর মধ্যেই ঈদ হয়েছিল। কলকাতার নিউমার্কেটে ছোট ভাইবোনদের জামাকাপড় কিনে দিয়েছিলাম।’

লুলু ই ফেরদৌস বলেন, ‘খোলা মাঠে তাঁবুতে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দেন। একদিন মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে এক মুক্তিযোদ্ধা আসেন। তাঁর অবস্থা বেশ গুরুতর ছিল। মাথা দিয়ে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। আমার হাতের ওপরই মারা যান সেই যোদ্ধা। অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাকে সেবা দিয়েছি। খাবার দিয়েছি। তাঁদের কষ্ট দেখলে মুখে ভাত তুলতে পারতাম না। সুস্থ হয়ে অনেকেই যুদ্ধে চলে যেতেন।’

ডিসেম্বরে দুই বোন খবর পান, দেশ স্বাধীন হয়েছে। সেদিন আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলেন তাঁরা। ভারতীয়দের মিষ্টিমুখ করিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে পরিবারসহ কুষ্টিয়ায় ফিরে আসেন তাঁরা। আসার সময় ভারত সরকার তাঁদের কাজের স্বীকৃতিপত্র দেয়।