সেলিম খানদের জমিতেই বিশ্ববিদ্যালয় করতে মন্ত্রণালয়ে চিঠি উপাচার্যের

চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য প্রস্তাবিত স্থান
ফাইল ছবি

চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির ঘনিষ্ঠ যে ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ভূমি অধিগ্রহণসংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল, তাঁদের জমিই অধিগ্রহণ করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য মো. নাছিম আখতার।

তবে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দলিলে দেখানো ৫৫৩ কোটি টাকায় নয়, চাঁদপুরের জেলা প্রশাসকের প্রাক্কলিত ১৯৪ কোটি টাকাই বরাদ্দ চেয়ে আবেদন করা হয়েছে। গতকাল রোববার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর এ চিঠি পাঠান উপাচার্য।

যে এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়টি করার জন্য স্থান ঠিক করা হয়েছে, এর বেশির ভাগের মালিক চাঁদপুর সদরের ১০ নম্বর লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. সেলিম খান ও তাঁর স্বজনেরা। তিনি চাঁদপুরে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।

চিঠিতে উপাচার্য উল্লেখ করেন, নদীবন্দর চাঁদপুর থেকে আড়াই কিলোমিটার দূরে সদর উপজেলার ১১৫ নম্বর লক্ষ্মীপুর মৌজায় ৬২ দশমিক ৫৪৯০ একর জমি চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী সরেজমিন পরিদর্শন করা হয়েছে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের যথার্থতা যাচাই করে অর্থ বরাদ্দের জন্য হালনাগাদ প্রাক্কলনের অনুরোধ করা হয়। এর ভিত্তিতে সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে জেলা প্রশাসক এ জমির সর্বমোট মূল্য ১৯৩ কোটি ৯০ লাখ ৬৫ হাজার ৫০৭ টাকা প্রাক্কলন করেন। প্রাক্কলিত অর্থ ১২০ কার্যদিবসের মধ্যে ভূমি অধিগ্রহণ কেস খাতের নির্দিষ্ট কোড নম্বরে জমা দেওয়ার জন্য চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক অনুরোধ করেছেন। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এই অর্থ জমা না দেওয়া হলে স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল আইন অনুযায়ী অধিগ্রহণ কেসটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে।

এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপনের জন্য সরকার কর্তৃক ভূমি অধিগ্রহণের আগেই সেখানকার সাড়ে ৬২ একর জমি মৌজা দরের চেয়ে ২০ গুণ বেশি দাম দেখিয়ে দলিল করে নেয় প্রভাবশালী একটি গোষ্ঠী। অভিযোগ রয়েছে, সরকারের কাছ থেকে ৩৫৯ কোটি টাকা বাড়তি নেওয়ার এ কারসাজিতে জড়িত ব্যক্তিরা শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির ঘনিষ্ঠ বলে এলাকায় পরিচিত। এর মধ্যে তাঁর নিকটাত্মীয়ও আছেন। তাঁরা ভূমি অধিগ্রহণে প্রশাসনিক অনুমোদনের আগেই চাঁদপুর সদর উপজেলার ১০ নম্বর লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের জায়গাটি ঠিক করে নিজেদের নামে দলিল করিয়ে নেন। পরবর্তী সময়ে সেসব জমিই প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নির্বাচন করে এবং জেলা প্রশাসনকে অধিগ্রহণের জন্য বলে। গতকাল সেই জমিই অধিগ্রহণের জন্য চিঠি দিয়েছেন উপাচার্য।

আরও পড়ুন

গত নভেম্বরে জেলা প্রশাসনের এ-সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকার ভূমি অধিগ্রহণের অনুমোদন দেয় গত বছরের ৬ এপ্রিল। এরপর মাঠপর্যায়ে জমির অস্বাভাবিক মূল্য দেখে জেলা প্রশাসন ভূমি অধিগ্রহণের জন্য ১৩ সদস্যের কমিটি করে দেয়। সেই কমিটি নির্ধারিত মৌজার জমি বেচাকেনার দলিল পর্যালোচনা করে ১৩৯টি দলিল পায় ‘অস্বাভাবিক উচ্চ মূল্যে’ (২০ গুণ বেশি দামে) নিবন্ধন (রেজিস্ট্রি) করা। এসব দলিল হয়েছে ২০২০ সালের ১৮ মে থেকে ২০২১ সালের ১৫ মের মধ্যে। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়-সংক্রান্ত কার্যক্রম শুরুর পর। ওই জমির দাগ নম্বরের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রস্তাবিত জমির দাগ নম্বরের মিল আছে। আবার ওই সব দাগের বাইরে একই মৌজায় একই সময়ে সম্পাদিত ৪০টির বেশি জমি কেনাবেচার দলিল পাওয়া গেছে, যার মূল্য সরকারি মৌজা দরের কাছাকাছি। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপনের জন্য যে জায়গাটি ঠিক করা হয়েছে, কেবল ওই সব দাগের জমির দলিলে অস্বাভাবিক দাম দেখানো হয়েছে।

সরেজমিন এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্থানীয় লোকজন থেকে এসব জমি নেওয়া হয়েছে অনেকটা জোর করে। এ ক্ষেত্রে কাউকে নামমাত্র দাম দেওয়া হয়েছে। কাউকে আবার জমি অধিগ্রহণের টাকা হাতে পেলে জমির দাম পরিশোধের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। কেবল কৃষিজমির মালিকদের কিছু টাকা দেওয়া হয়েছে। এই কাণ্ডের নেপথ্যে রয়েছেন ১০ নম্বর লক্ষ্মীপুর মডেল ইউপির চেয়ারম্যান মো. সেলিম খান।

জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখা বলছে, ওই এলাকার প্রকৃত মৌজা দর ধরে জমি অধিগ্রহণের দাম নির্ধারণ করলে সাড়ে ৬২ একরের জন্য (মূল দামের তিন গুণ ধরে) সরকারের ব্যয় হবে প্রায় ১৯৪ কোটি টাকা। কিন্তু হঠাৎ উচ্চ মূল্য দেখিয়ে যেসব দলিল করা হয়েছে, সেটা আমলে নিলে সরকারকে ৫৫৩ কোটি টাকা দিতে হবে। অর্থাৎ সরকারকে অতিরিক্ত দিতে হবে ৩৫৯ কোটি টাকা।

জেলা প্রশাসনের প্রাক্কলন করা ১৯৪ কোটি টাকা সংশোধন করে বর্ধিত দরে প্রাক্কলনের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন মো. সেলিম খান। এ নিয়ে উচ্চ আদালতে একটি রিট খারিজ হয়। এরপর সেলিম খান আরেকটি রিট করেছেন।

চিঠির বিষয়ে চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. নাছিম আখতার আজ সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভূমি অধিগ্রহণে মূল্যসংক্রান্ত জমির মালিক সেলিম খান গংদের করা রিট মামলার রায় ঘোষণার জন্য আগামী ২০ এপ্রিল তারিখ ধার্য করা হয়। মামলার রায় কী হবে, তা তো জানি না। তবে আদালত থেকে এই ভূমি অধিগ্রহণের স্থিতাবস্থা উঠে যাওয়ায় টাকা বরাদ্দ চেয়েছি।’

জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, ‘আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণের জন্য ১৯৩ কোটি ৯০ লাখ টাকার প্রাক্কলন দিয়েছি। এর বিরুদ্ধে সেলিম খান আদালতে রিট করেছিলেন। ওই মামলার রায় হবে ২০ এপ্রিল। তবে টাকা বরাদ্দ এলে আমরা নির্ধারণ করব কোথায় বিশ্ববিদ্যালয় হবে।’