সোনায় মোড়ানো সাফল্য

লালমনিরহাটের নিভৃত পল্লির মেয়ে সান্ত্বনা রানী রায়। তায়কোয়ান্দো শিখে দেশ-বিদেশে তিনি সুনাম কুড়িয়েছেন। এখন দিচ্ছেন প্রশিক্ষণ।

দরিদ্র পরিবারে বেড়ে উঠেছেন তিনি। ছোটবেলায় নতুন জামা কিনে দিতে পারেননি মা-বাবা। ওই সময় থেকেই অভাবের সঙ্গে লড়াই করে এগিয়ে চলেছেন। একটু বড় হয়ে পড়ালেখার পাশাপাশি ছোট ভাইবোনের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে করেছেন গৃহশিক্ষকতা। জীবনের অনেক শখই পূরণ হয়নি। তবে স্বপ্ন দেখতেন দেশ ও দেশের মানুষের জন্য বড় কিছু করার। সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য শেষ পর্যন্ত শিখলেন তায়কোয়ান্দো। তায়কোয়ান্দো শিখে নিজেকে শাণিত করার পাশাপাশি অর্জন করলেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। আত্মরক্ষার এ কৌশল শেখাতে শুরু করলেন মেয়েদের। তাঁর পাশাপাশি অনেক শিক্ষার্থীও পেলেন স্বর্ণ, রৌপ্য ও ব্রোঞ্জ পদক। সব মিলিয়ে তাঁদের ঝুলিতে রয়েছে ৬০টি পদক। এখন তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে।

তায়কোয়ান্দো প্রতিযোগিতায় ঈর্ষণীয় সাফল্য পাওয়া এই অদম্য নারীর নাম সান্ত্বনা রানী রায়। বাড়ি লালমনিরহাটের আদিতমারীর সারপুকুর ইউনিয়নের হরিদাস গ্রামে। বাবা সুবাস চন্দ্র রায় একজন কৃষক। মা যমুনা রানী রায় গৃহিণী, একসময় গণশিক্ষা কার্যক্রমে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে জড়িত ছিলেন। যমুনা রানী যোগব্যায়াম জানতেন। কিশোরী বয়সে সান্ত্বনা মায়ের কাছ থেকে যোগব্যায়াম শেখেন।

সান্ত্বনা রানীরা তিন বোন আর এক ভাই। সান্ত্বনা সবার বড়। এক বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, জনসেবা ও তায়কোয়ান্দো নিয়েই তাঁর চিন্তাভাবনা, কাজের ভুবন। তাঁর সবকিছু ঘিরে মার্শাল আর্টে থাকার কারণ আছে অনেক। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে তায়কোয়ান্দো প্রতিযোগিতায় তাঁর অসাধারণ অর্জন। তিনি ২০১১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে ১৪টি পদক পেয়েছেন। এর বেশির ভাগই স্বর্ণপদক। তিনি ১০টি স্বর্ণ, ২টি রৌপ্য ও ২টি ব্রোঞ্জ পদক পেয়েছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত লালমনিরহাট তায়কোয়ান্দো অ্যাসোসিয়েশনের (এলটিএ) শিক্ষার্থীরাও বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অতুলনীয় সাফল্য পেয়েছেন। তাঁরা পেয়েছেন ৪৬টি পদক।

সান্ত্বনা রানী রায়ের এই ধারাবাহিক সাফল্যের স্বীকৃতি দিয়েছে সরকার। প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি–বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় সাভারের শেখ হাসিনা জাতীয় যুব উন্নয়ন ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে তাঁর হাতে জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড ২০১৮ তুলে দেন। এলটিএর পরিচালক হিসেবে দেশের তরুণ-তরুণীদের ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করার জন্য তাঁকে এ পুরস্কার দেওয়া হয়। পুরস্কার পেয়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে যান তিনি। এ সময় বাংলাদেশ টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার হওয়া অনুষ্ঠানে সান্ত্বনা রানী বলেছিলেন, ‘আমি চাই, বাংলাদেশের ঘরে ঘরে আমার মতো মার্শাল আর্টকন্যা তৈরি হোক। সে জন্য লালমনিরহাট তায়কোয়ান্দো অ্যাসোসিয়েশন কাজ করে যাচ্ছে। আমাকে এ কাজে অনেকেই নানাভাবে সহযোগিতা করছেন।’

*সান্ত্বনা রায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে ১৪টি পদক পেয়েছেন। এর মধ্যে ১০টি স্বর্ণ, ২টি রৌপ্য ও ২টি ব্রোঞ্জ পদক। * লালমনিরহাট তায়কোয়ান্দো অ্যাসোসিয়েশনের (এলটিএ) শিক্ষার্থীরাও বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অতুলনীয় সাফল্য পেয়েছেন। তাঁরা পেয়েছেন ৪৬টি পদক। * সান্ত্বনা এখন এলাকায় বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কাজ করেন, প্রচার–প্রচারণা চালান। অসচ্ছল নারীদের কর্মসংস্থানের জন্য তিনি গড়ে তুলেছেন সান্ত্বনা হ্যান্ডিক্রাফটস।

তায়কোয়ান্দোতে হাতেখড়ি যেভাবে

ফুটবলসহ নানা ধরনের খেলাধুলার সুযোগ থাকলেও হঠাৎ তায়কোয়ান্দোতে আগ্রহী হওয়ার কারণ জানতে চাইলে সান্ত্বনা বলেন, রংপুর সরকারি কলেজে পড়ার সময় ২০০৫ সালে তিনি ওই কলেজের প্রাঙ্গণে শিক্ষার্থীদের মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষণ নিতে থাকেন। পরে খোঁজখবর নিয়ে তিনি জানতে পারেন মার্শাল আর্ট শিখলে আত্মরক্ষার কৌশল রপ্ত করা হয়। এ ছাড়া এতে নিয়মশৃঙ্খলা মেনে চলতে হওয়ায় শরীরও সুস্থ-সবল থাকে। এ কারণে তিনি তায়কোয়ান্দো শিখতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।

ওই আগ্রহ থেকেই সান্ত্বনা রানী রায় ২০০৫ সালে রংপুরের সিতোরিও কারাতে দো, ২০১০ সালে রাজশাহীর তায়কোয়ান্দো অ্যাসোসিয়েশন, ২০১১ সালে ঢাকার সেন্ট্রাল তায়কোয়ান্দো অ্যাসোসিয়েশন থেকে তায়কোয়ান্দোর ওপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তিনি ২০১১ সালে রাজধানী ঢাকায় পরীক্ষা দিয়ে ব্ল্যাকবেল্ট - প্রথম ড্যান এবং ২০১৮ সালে দ্বিতীয় ড্যান অর্জন করেন।

ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখা গেছে, তায়কোয়ান্দো একটি মার্শাল আর্ট ও দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় খেলা। এটা যুদ্ধকৌশল, আত্মরক্ষা, খেলাধুলা, ব্যায়াম ও কিছু ক্ষেত্রে ধ্যান–দর্শনের সম্মিলন।

সান্ত্বনার বহুমাত্রিক কাজ

আমাদের দেশে রাস্তাঘাট, অফিস, এমনকি ঘরেও নারীরা ধর্ষণ, যৌন হয়রানিসহ নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হন। এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে এবং কিশোরী ও তরুণীদের নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সান্ত্বনা রানী লালমনিরহাটে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এর নাম দেওয়া হয় লালমনিরহাট তায়কোয়ান্দো অ্যাসোসিয়েশন (এলটিএ)। অসচ্ছল নারীদের প্রশিক্ষণের জন্য তিনি নিজ গ্রামে ‘সান্ত্বনা হ্যান্ডিক্রাফটস’ নামের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন।

সান্ত্বনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

সান্ত্বনা রানী রায় বলেন, ‘আমি সান্ত্বনা হ্যান্ডিক্রাফটসকে শক্তিশালী ভিতের ওপর দাঁড় করাতে চাই। এ জন্য আমার নিজ গ্রাম বা আশপাশের এলাকায় ৫০ শতক খাসজমি বরাদ্দ দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের মাধ্যমে গত আগস্টে একটি আবেদন করেছি।’

বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক তায়কোয়ান্দো অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইটিএ) সেক্রেটারি জেনারেল মাস্টার সোলাইমান সিকদার বলেন, ‘আমি সান্ত্বনাকে তায়কোয়ান্দো প্রশিক্ষণ দিয়েছি। উপযুক্ত পরিবেশ ও সহায়তা পেলে সে একদিন বাংলাদেশের সেরা কোচ হবে।’ লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক আবু জাফর বলেন, ‘লালমনিরহাটের নারী ক্রীড়া জগতের যাঁদের নিয়ে আমরা গর্ব করি, যাঁদের মাঝে উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখতে পাই, তাঁদের মধ্যে অন্যতম মার্শাল আর্টকন্যা সান্ত্বনা রানী রায়। আমরা তাঁকে নানাভাবে সহায়তা করেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘খাসজমি বরাদ্দসংক্রান্ত সান্ত্বনা রানী রায়ের একটি আবেদন পেয়েছি। ওই আবেদন নিয়ে কাজ করা হচ্ছে, কিছুটা সময় লাগছে।’