সৌন্দর্যবর্ধনের নামে পুনর্বাসন!

ফুটপাতের অর্ধেক দখল করে চট্টগ্রাম নগরের জামালখানে তৈরি হয়েছে অ্যাকুয়ারিয়াম।সৌরভ দাশ

ফুটপাতেই অ্যাকুয়ারিয়াম বসানোর অনুমতি দেয় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। কিন্তু ফুটপাতসহ পাশের উন্মুক্ত নালা দখল করে নির্মাণ করা হয় পাকা স্থাপনা। সেখানে বসানো হয় অ্যাকুয়ারিয়াম।

চট্টগ্রাম নগরের জামালখান এলাকার পিডিবি কলোনি-সংলগ্ন ফুটপাতে অ্যাকুয়ারিয়াম ও আলোকায়নের জন্য লিংক অ্যাপারেলস নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে পাঁচ বছরের জন্য বরাদ্দ দেয় সিটি করপোরেশন। প্রতিষ্ঠানটি এখন অ্যাকুয়ারিয়ামে রাখার মাছ বিক্রি করছে। ব্যবসা করলেও প্রতিষ্ঠানটি বছরে কর হিসেবে করপোরেশনকে মাত্র ১ লাখ টাকা পরিশোধ করছে।
জামালখানের এ স্থাপনার মতো নগরের বিভিন্ন এলাকায় সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য ৩৫টি প্রতিষ্ঠানকে বরাদ্দ দিয়েছে সিটি করপোরেশন। কিন্তু এ সুযোগে অনেক প্রতিষ্ঠান ফুটপাতে গড়ে তুলেছে দোকান। যাত্রীছাউনিতে বসিয়েছে নানা ধরনের স্টল। এমনকি উন্মুক্ত উদ্যানে নির্মাণ করা হয়েছে বিপণিবিতান। এ ছাড়া বিদ্যমান বিপণিবিতানের গাড়ি রাখার জায়গায় এবং খোলা অংশে দোকান নির্মাণেরও অনুমতি দিয়েছে সিটি করপোরেশন।

সিটি করপোরেশনের বিদায়ী মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের আমলে ২০১৬ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত নগরের ৪১টি এলাকা সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য ইজারা দেওয়া হয়। তবে এসব ক্ষেত্রে অনিয়ম হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন সিটি করপোরেশনের প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন। এ ব্যাপারে তদন্ত শুরুর নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ৩৫টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চারটিকে একাধিক এলাকার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠান নগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দীন চৌধুরীর ছেলের। এ ছাড়া যুবলীগ নেতা, পরিবহন মালিক সমিতি ও সাংবাদিকের প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। সর্বনিম্ন ৫ বছর থেকে সর্বোচ্চ ২০ বছরের জন্য করপোরেশন প্রতিষ্ঠানগুলোকে এসব জায়গা বরাদ্দ দেয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের তেমন আয় হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে পত্রিকায়ও বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়নি।

জায়গা করপোরেশনের, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের
সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য বরাদ্দ দেওয়া ফুটপাত, সড়ক বিভাজক, সড়কদ্বীপ, গোল চত্বরগুলোর জায়গার মালিক সিটি করপোরেশন। কিন্তু সৌন্দর্যবর্ধনের নামে সিটি করপোরেশন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ব্যবসা করার সুযোগ করে দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন করপোরেশনের তিন কর্মকর্তা।

সৌন্দর্যবর্ধনের বিপরীতে একাধিক প্রতিষ্ঠান রাস্তার দুই পাশের ফুটপাতে যাত্রীছাউনি, কুলিং কর্নার, এটিএম বুথ, ক্যাফে, গণশৌচাগার, পর্যটনসেবা স্টল, ডিজিটাল স্ক্রিন, স্টল স্থাপনের অনুমতি পেয়েছে। সরেজমিন ঘুরে এবং সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সৌন্দর্যবর্ধনের দায়িত্ব পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো দোকান নির্মাণ করে তা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ভাড়া দিয়েছে। এ ছাড়া ডিজিটাল স্ক্রিনের নামে বিভিন্ন কোম্পানির পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রদর্শনের ঘটনা ঘটেছে।

স্ক্রিপ্ট ও অডিওস ইঙ্ক নামের দুটি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে তিনটি এলাকার সৌন্দর্যবর্ধনের দায়িত্ব পায়। নগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দীন চৌধুরীর ছেলে ইশতিয়াক আহমেদ চৌধুরীর প্রতিষ্ঠান এসটিডি ইন্টারন্যাশনাল ও যুবলীগ নেতার প্রতিষ্ঠান অ্যাড গার্ডেন যৌথভাবে তিনটি এলাকার কাজ পায়। আরশিনগর দুটি এলাকার এবং ট্রেডম্যাক্স দুটি উড়ালসড়কের ওপর ও নিচে সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য বরাদ্দ পায়। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো ন্যূনতম একটি করে এলাকার আধুনিকায়ন ও সবুজায়নের দায়িত্ব পেয়েছে।

নগরের ২ নম্বর গেটের বিপ্লব উদ্যান ঢাকার রিফর্ম লিমিটেড ও চট্টগ্রামের স্টাইল লিভিং আর্কিটেক্টস ২০ বছরের জন্য ইজারা দেওয়া হয়েছে। উন্মুক্ত এই উদ্যানে আধুনিকায়নের পাশাপাশি দ্বিতল বিপণিবিতান নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে প্রায় ২৫টি দোকান রয়েছে।
এ ছাড়া নগরের আমতলের শাহ আমানত সুপার মার্কেটের গাড়ি রাখার জায়গায় দোকান নির্মাণ করা হয়েছে। ষোলশহর শপিং কমপ্লেক্সের উন্মুক্ত স্থানে স্থাপনা নির্মাণের কাজ চলছে। কমপ্লেক্সের ব্যবসায়ীরা এর প্রতিবাদ করে আসছেন।

বরাদ্দ পাওয়া অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান অনেক ক্ষেত্রেই চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রায় সব প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। চুক্তি ভঙ্গ করে স্থাপনা নির্মাণ করেছে। ফুটপাতের ওপর নির্মিত যাত্রীছাউনিতে দোকান বসানোর কারণে মানুষের হাঁটার পথ সংকুচিত হয়েছে।

মানা হয়নি শর্ত
লিংক অ্যাপারেলসকে ফুটপাতের কথা বললেও তারা অ্যাকুয়ারিয়াম স্থাপন করেছে নালার ওপর।
নগরের এম এম আলী সড়কের মুখে সিটি করপোরেশনের দেড় শ বছর স্মারক স্তম্ভ উদ্যানে দোকান বসানো হয়েছিল। পরে তা উচ্ছেদ করা হয়। নগরের পাঁচলাইশের মক্কী মসজিদ থেকে প্রবর্তক মোড় পর্যন্ত সৌন্দর্যবর্ধন করার কথা থাকলেও গ্রিড ওয়ান নামের প্রতিষ্ঠান তা পুরোপুরি করেনি।

জামালখানের ফিশ অ্যাকুয়ারিয়াম স্থাপনকারী লিংক অ্যাপারেলসের অন্যতম মালিক শুভাশীষ দাশ বলেন, ‘এ বিষয়ে কাউন্সিলর সুমনদা (শৈবাল দাশ) ভালো বলতে পারবেন। করপোরেশন আমাদের যে জায়গা দিয়েছে সেখানেই অ্যাকুয়ারিয়াম বসিয়েছি।’
গ্রিড ওয়ানের সুমন বসাক দাবি করেন, করপোরেশনের বুঝিয়ে দেওয়া জায়গায় তাঁরা সৌন্দর্যবর্ধন করেছেন।

এসটিডির ইশতিয়াক আহমেদ চৌধুরী বলেন, করোনা ও রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কারণে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করা সম্ভব হয়নি।
জানতে চাইলে সিটি করপোরেশনের প্রধান নগর–পরিকল্পনাবিদ এ কে এম রেজাউল করিম স্বীকার করেছেন, কিছু প্রতিষ্ঠান চুক্তির শর্ত অনুযায়ী কাজ করেনি। তিনি বলেন, বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যেভাবে যেভাবে করার কথা, অনেক জায়গায় তা হয়নি। এখানে গরমিলের জন্য দায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে দাবি করেছেন, যথাযথ নিয়ম মেনে প্রতিষ্ঠানগুলোকে সৌন্দর্যবর্ধনের ইজারা দেওয়া হয়েছে।

ইজারা দিয়ে নামমাত্র আয় করপোরেশনের
৩০টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে করা চুক্তির শর্তগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, তাদের মধ্যে মাত্র ১৪টি প্রতিষ্ঠান বার্ষিক টাকা দেওয়ার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়। তার পরিমাণও খুব কম। বার্ষিক সর্বনিম্ন ৩০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত দেওয়ার তথ্য পাওয়া যায়।
চুক্তি অনুযায়ী, নগরের জিপিও থেকে পুরাতন রেলস্টেশন এবং নিউমার্কেট থেকে আমতল পর্যন্ত ৯টি যাত্রীছাউনি, যাত্রীছাউনিতে দোকান, দুটি গণশৌচাগার, পদচারী–সেতুতে চারটি স্টল, এটিএম বুথসহ বিভিন্ন স্থাপনা অনুমতি পায় অডিওস ইঙ্ক ও স্ক্রিপ্ট নামের দুটি প্রতিষ্ঠান। এর বিপরীতে বছরে কর ধার্য করা হয়েছে ১ লাখ টাকা। একইভাবে নগরের আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায় সৌন্দর্যবর্ধনের বিপরীতে সিটি করপোরেশনকে বছরে ১ লাখ টাকার কর দেওয়ার চুক্তি হয় এসটিডি ও অ্যাড গার্ডেনের সঙ্গে।

অন্য ১২টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও এ ধরনের চুক্তি হয়েছে। বিপ্লব উদ্যানের আধুনিকায়নের জন্য বরাদ্দ প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে বার্ষিক কর ধরা হয়েছে মাত্র ১ লাখ টাকা।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সৌন্দর্যবর্ধন কার্যক্রম প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, রাস্তা সংস্কার, নালা পরিষ্কার ও মশা মারার মতো প্রয়োজনীয় কাজগুলো করার চেয়ে সৌন্দর্যবর্ধনে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল সিটি করপোরেশন। এর মাধ্যমে ফুটপাতে ফুটপাতে দোকান হয়েছে। এই কাজ ঘিরে সিন্ডিকেট গড়ে ওঠার কথা শোনা যায়। আর সৌন্দর্যবর্ধনের নামে দিন শেষে কিছু নিজেদের লোককে ব্যবসা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। ফুটপাত সংকুচিত করে দোকান করার বিষয়টি মানুষ পছন্দ করেনি।