স্কুল মাঠে বসে টিফিন ভাগ করে খায় ওরা

বাড়ি থেকে আনা টিফিন একসঙ্গে মাঠে বসে খাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। আজ দুপুরে রানীশংকৈল উপজেলার গন্ডগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে
ছবি: প্রথম আলো

বিরতির ঘণ্টা বেজে উঠল আর শ্রেণিকক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে এল শিক্ষার্থীরা। সবার হাতে টিফিন বক্স। স্কুল মাঠে গিয়ে গোল হয়ে বসে পড়ল ওরা। এরপর টিফিন বক্স খুলে খেতে শুরু করল। খেতে খেতে একে অপরের সঙ্গে করল খাবার বিনিময়। আজ রোববার দুপরে ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার গন্ডগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে এ দৃশ্যের দেখা মেলে।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলায় মোট ৯৯৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এসব বিদ্যালয়ে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পাঠদান চলে। আর দুপুর সোয়া ১২টা থেকে বিকেল সোয়া ৪টা পর্যন্ত চলে তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ক্লাস। এর মধ্যে আধা ঘণ্টা বিরতি পায় শিক্ষার্থীরা।

বেলা একটার দিকে ওই বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, মাঠে সবাই গোল হয়ে বসে খাবার খাচ্ছে। টিফিন বক্স কেউ এনেছে ভাতের সঙ্গে সবজি-ভাজি, কেউ এনেছে ডিম ভাজি, আবার কেউ মুরগির মাংস। খেতে খেতে তারা নানা গল্প ও খুনসুটিতে মেতে উঠছে। এর ফাঁকেই সঙ্গীর সঙ্গে করছে খাবার বিনিময়।

স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী জেসমিন আকতার জানায়, প্রতিদিন তারা সামর্থ্য অনুযায়ী খাবার নিয়ে আসে। পরে টিফিনের বিরতিতে দল বেঁধে সে খাবার খায়। জেসমিন বলে, ‘এভাবে সবাই মিলে খেতে ভালো লাগে। যখন দেখি পাশের কারও টিফিন বক্সে তরকারি কম, তখন নিজেদের মধ্যে খাবার বিনিময় করি।’ বলতে বলতে পাশে বসা তুলসী রানীর পাতে মুরগির ডিমের অর্ধেকটা তুলে দেয় সে।

আরেক পাশে গোল করে বসে খাচ্ছিল পঞ্চম শ্রেণির পাঁচ শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে তুষার আলী বাড়ি থেকে এনেছে মুরগির মাংস, আলী হামজা একটা গোটা ডিম ভুনা আর আমীর আলী এনেছে সবজি-ভাজি-ডাল। খেতে বসার শুরুতেই তুষার আমীরের পাতে তুলে দেয় এক টুকরা মাংস। তা দেখে হামজাও ডিমের একটা অংশ ভেঙে আমীরের পাতে দেয়।

এ সময় তুষার আলী বলে, ‘সবাই সব দিন বাড়ি থেকে ভালো খাবার আনতে পারে না। আবার কেউ কেউ প্রতিদিনই ভালো খাবার আনে। আমরা ভালো খাবারগুলো একে অন্যের সঙ্গে বিনিময় করি।’ বলতে বলতে হাপুস-হুপুস করে খাবার শেষ করে ফেলে তুষার।

মাঠে বসে খাবার খাওয়ার বিষয়ে চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী স্বপ্না রায় বলে, ‘শ্রেণিকক্ষে বসে খাবার খেলে বেঞ্চ-মেঝে নোংরা হয়। সেগুলো পরিষ্কার করতে কষ্ট হয়। এ কারণে মাঠে বসেই খাই।’

১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত স্কুলটি ২০১৩ সালে জাতীয়করণ হয়। বর্তমানে স্কুলে ১৮৭ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। স্কুলটির সহকারী শিক্ষক মোছা. শামসুন্নাহার বলেন, তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে ১০৪ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। স্কুলের মধ্যবিরতিতে এভাবে দল বেঁধে খাবার খায় ওরা। এসব শিক্ষার্থী যখন নিজেদের মধ্যে খাবার বিনিময় করে, তখন মনটা ভরে যায়।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. হারুনর রশিদ বলেন, ‘একসময় স্কুলে মিড ডে মিল চালুর পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এরপর পরিকল্পনা বদলে মায়েদের সচেতন করা হয়, যাতে তাঁরা সন্তানদের খাবার দিয়ে স্কুলে পাঠান। মিড ডে মিলের দায়িত্ব এখন মায়েরা পালন করছেন। আমরা শুধু প্রত্যেক শিশুকে টিফিন বক্স দিয়েছি।’

তিনি বলেন, ‘এভাবে একসঙ্গে খাবার খাওয়ার ফলে শিশুরা ভ্রাতৃত্ববোধ ও সহমর্মিতা শিখছে। শিশুদের মধ্যে মানবিকতার শিক্ষাটা ছড়িয়ে দেওয়া খুব জরুরি। এটা যুগ যুগ টিকিয়ে রাখতে চাই।’