স্বপ্ন ডানা মেলেছে লাল পাহাড়ে

প্রতিষ্ঠাতা ড. আখতার হামিদ খানের নেতৃত্বে গবেষকেরা গ্রামের লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে কিছু মডেল কর্মসূচি উদ্ভাবন করেন। সমাধানের পথ দেখান।

কুমিল্লার কোটবাড়িতে পল্লি উন্নয়নের প্রশিক্ষণ ও গবেষণা পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বার্ডের যাত্রা শুরু হয়েছিল
ছবি: প্রথম আলো

সেই ১৯৫৯ সালের কথা। আজ থেকে ৬২ বছর আগে। আখতার হামিদ খান নামের এক সমাজবিজ্ঞানী শিক্ষক গতানুগতিক কাজের বাইরে অন্য রকম স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল গ্রামকে ঘিরে। গ্রামের উন্নয়নের মাধ্যমেই তিনি মানুষ ও সমাজের আর্থসামাজিক মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেসব স্বপ্ন ডানা মেলেছে কুমিল্লায় তাঁর প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমির (বার্ড) মাধ্যমে।

বার্ডের শুরুর দিনগুলোর কথা বলছিলেন আখতার হামিদ খানের সহচর ও কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার যাত্রাপুর গ্রামের বিশিষ্ট সমবায়ী মো. সিরাজুল হক (৭১)। তিনি বলেন, পঞ্চাশের দশকে আখতার হামিদ খান কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। অর্ধেকের মতো শিক্ষার্থী ক্লাসে আসত না, বিষয়টি তাঁকে ভাবিয়ে তোলে। তিনি সাইকেল চালিয়ে শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি যেতেন। সেই বাড়ি বাড়ি যাওয়া তাঁর জীবনকে বদলে দেয়। কতটা দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করে এসব শিক্ষার্থী পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে, তা দেখে তিনি গ্রামের মানুষের উন্নয়নে একটা কিছু করার তাগিদ অনুভব করেন।

সিরাজুল হক বলছিলেন, ১৯৫৯ সালের ২৭ মে কুমিল্লার কোটবাড়ীতে পল্লি উন্নয়নের প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও প্রায়োগিক গবেষণা পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বার্ড যাত্রা শুরু করে। প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ড. আখতার হামিদ খানের নেতৃত্বে কয়েকজন গবেষক গ্রামের লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে কিছু মডেল কর্মসূচি উদ্ভাবন করেন। তাঁরা প্রথমে গ্রামাঞ্চলের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করেন। এরপর কী উপায়ে সেসব সমস্যার সমাধান করা যায়, এর পথ খোঁজেন। গ্রামে টেকসই সংগঠন সৃষ্টি, ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত পুঁজি সৃষ্টি, স্বাস্থ্য-শিক্ষার প্রসার, কৃষি খাতের মাধ্যমে কর্মসংস্থানসহ নয়টি বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে বার্ড কাজ শুরু করে। আখতার হামিদ খান প্রথমে কৃষক, রিকশাচালক ও মৃৎশিল্পীদের নিয়ে সমবায় সমিতি চালু করেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সমবায়ভিত্তিক উদ্যোগ তো এখন খুবই পরিচিত।

বার্ডের নানা কর্মকাণ্ড প্রসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ মীর কাসেম বলেন, ষাটের দশকে আখতার হামিদ কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার দক্ষিণ রামপুর এলাকায় যান। দেখতে পান ওই এলাকা নিচু। বছরে এক ঋতুতে ধান হয়। খরা ও শীত মৌসুমে মাঠে কোনো ফসল নেই। তখন তিনি কৃষকদের নিয়ে সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমবায় সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। গ্রামের কৃষকেরা চাঁদা দিয়ে সদস্য হন। পরে কৃষকদের জন্য তিনি গভীর নলকূপ স্থাপন করে সেচকাজ শুরু করেন। ফিলিপাইনের ম্যানিলা থেকে ইরি ধানের জাত আনেন। তখন ওই এলাকায় বছরে তিন ঋতুতে ধান উৎপাদন শুরু হয়।

মোহাম্মদ মীর কাসেম বলছিলেন, কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার বলরামপুর গ্রামে রিকশাচালকদের দিয়ে সমিতি করেন আখতার হামিদ খান। সদর দক্ষিণ উপজেলার বিজয়পুরে তিনি মৃৎশিল্পীদের জন্য সমবায় সমিতি করেন। সমিতির শুরুর সদস্য ছিল ১৫ জন। সমিতির নাম দেওয়া হয় বিজয়পুর রুদ্র পাল মৃৎশিল্প সমবায় সমিতি। শুরুতে সমিতির সদস্যরা ৫০ পয়সা চাঁদা দিয়ে সদস্য হন। আর ১০ টাকা করে শেয়ার কিনে মোট ১৫৭ টাকা ৫০ পয়সা দিয়ে সমিতির যাত্রা শুরু করেন। এখানকার মৃৎশিল্পীরা সারা বছর আগ্রহী ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণ দেন। এমন শত শত প্রশিক্ষিত কর্মী দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে মাটির কাজ করে যাচ্ছেন। বিজয়পুরের মাটির জিনিস এখন দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও বিক্রি হয়।

পল্লি উন্নয়ন, সমবায় আন্দোলন, প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও প্রায়োগিক গবেষণার ক্ষেত্রে ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশে-বিদেশে সুনাম অর্জন করেছে বার্ড। বাংলাদেশ সরকার অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বার্ডকে ১৯৮৬ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করেছে। বার্ডের ঝুলিতে ২০২১ সালে জমা হয়েছে ‘জাতীয় পল্লী উন্নয়ন পদক’। বার্ডের প্রতিষ্ঠাতা আখতার হামিদ খান ১৯৬৩ সালে, নারী কর্মসূচির কর্মী তাহেরা আবদুল্লাহ ১৯৭৮ সালে ও সমবায় প্রতিষ্ঠান দিদার সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমিতির প্রতিষ্ঠাতা মো. ইয়াছিন ১৯৮৮ সালে র‍্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পেয়েছেন।

কুমিল্লা শহর থেকে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে পাহাড় ও টিলাঘেরা কোটবাড়ী এলাকার ১৫৬ একর জমির ওপর বার্ড প্রতিষ্ঠা করা হয়। ময়নামতি পাহাড়ের অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্যকে অটুট রেখে গ্রিক স্থাপত্যের আদলে ডাক্স এডিস ফার্মের নকশায় তৈরি হয় এখানকার ভবনগুলো। এখানকার এক ভবন থেকে অন্য ভবনে যেতে কোনো রোদ লাগে না। বৃষ্টিতেও ভিজতে হয় না। আর ভবনগুলোর ফাঁকে ফাঁকে রয়েছে নানা দুর্লভ প্রজাতির ফুল ও ফলের গাছ।

বার্ড স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে পল্লি উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। বার্ডের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ১৮ সদস্যের একটি পরিচালনা পর্ষদ আছে। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি। আর বার্ডের মহাপরিচালক হলেন এর প্রধান নির্বাহী। বর্তমানে বার্ডে একজন মহাপরিচালক, একজন অতিরিক্ত মহাপরিচালক, নয়জন পরিচালক ও পঞ্চাশজন অনুষদ সদস্য আছেন।

বার্ড সূত্র জানায়, বার্ড উদ্ভাবিত পল্লি উন্নয়ন কর্মসূচি দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা বাস্তবায়ন করছে। এখন এখানে কাজ করেন ৪০০ জন। এখানে বিভিন্ন বিষয়ে প্রায় ৮৫০টি গবেষণা পরিচালনা করা হয়েছে। আর প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত পল্লি উন্নয়নের বিভিন্ন বিষয়ে চার লাখের বেশি মানুষকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। বার্ডে রয়েছে একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার। বার্ডের প্রতিষ্ঠাতার নামেই নামকরণ করা হয়েছে এই গ্রন্থাগারের। সেখানে আছে দেশ-বিদেশের প্রায় ৭০ হাজার বই।

ছয় দশকে বার্ডের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও বার্ডের সাবেক যুগ্ম পরিচালক তোফায়েল আহমেদ বলেন, বার্ডকে প্রশিক্ষণ কমিয়ে এখন গবেষণার দিকে আরও বেশি নজর দিতে হবে। বার্ডে এখন গ্রামভিত্তিক কৃষি গবেষণা কম হচ্ছে, এটা বাড়াতে হবে। সরকারের উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। বার্ডকে বিভিন্ন বিষয়ে ডিগ্রি দেওয়ার দক্ষতা অর্জন করতে হবে। বার্ডের জন্য একটি পূর্ণকালীন বোর্ড হওয়া দরকার।

তোফায়েল আহমেদ বলেন, পাকিস্তান আমলে বার্ড ছিল পল্লি উন্নয়নে এক ও অদ্বিতীয় প্রতিষ্ঠান। তখন পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার কুমিল্লা ও পেশোয়ারে দুটি একাডেমি করে। কিন্তু আখতার হামিদ খানের ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বের কারণে কুমিল্লার বার্ড ভালো করে। তখন মুখে মুখে ছড়ায় ‘কুমিল্লা মডেল’–এর নাম। বাংলাদেশ আমলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বার্ড ভূমিকা রাখে। তখন সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ বার্ডের সঙ্গে কাজ করত। এখন সেটি দেখা যায় না।

বার্ডের মহাপরিচালক মো. শাহজাহান জানান, বার্ড বর্তমানে ১৪টি প্রায়োগিক বিষয়ে গবেষণা চালাচ্ছে। ৬২ বছরে বার্ড এগিয়েছে অনেক দূর। তবে পাড়ি দিতে হবে আরও বহু পথ। বার্ডে বঙ্গবন্ধু স্কুল অব রুরাল ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট হচ্ছে। এখান থেকে গ্রামীণ গবেষণার বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়া হবে।