‘স্বপ্নপূরণের ফাঁদ’ আদিয়ানের

চুয়াডাঙ্গার আদিয়ান মার্ট লিমিটেডের বহু গ্রাহকের অভিযোগ, তাঁরা পণ্য পাচ্ছেন না। ফেরত পাচ্ছেন না টাকাও।

ই–কমার্স
প্রতীকী ছবি

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার মোমিনপুরের কাপড় ব্যবসায়ী সুব্রত কুমার দত্ত। মোটরসাইকেল কেনার জন্য গত ১০ মে একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানকে ১ লাখ ৭ হাজার ৯৪০ টাকা দেন। টাকা জমা দেওয়ার ২৫ দিনের মধ্যে তাঁর মোটরসাইকেল পাওয়ার কথা। কিন্তু পাঁচ মাস চলে গেলেও তিনি তা পাননি।

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আদিয়ান মার্ট লিমিটেডের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আরও অনেক গ্রাহকের। তাঁরা বলছেন, ২৫ থেকে ৮০ শতাংশ ছাড়ে মুঠোফোন, মোটরসাইকেল, ইলেকট্রনিকসসহ নানা পণ্যের ক্ষেত্রে ‘ধামাকা’ অফার দিয়ে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করে প্রতিষ্ঠানটি। তাদের ‘লোভনীয় ছাড়ের’ ফাঁদে পড়ে তাঁরা এখন দিশেহারা। তাঁরা না পাচ্ছেন পণ্য, না পাচ্ছেন টাকা।

‘স্বপ্নপূরণ হবে সাধ্যের মধ্যে’ স্লোগানে যাত্রা শুরু করা এই ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে ১১৬টি অভিযোগ জমা পড়েছে। এ ছাড়া জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের কার্যালয়েও অভিযোগ দিয়েছেন অনেকে। এসব অভিযোগের মধ্যে কিছু নিষ্পত্তি হলেও বেশির ভাগই অমীমাংসিত রয়ে গেছে।

আদিয়ান মার্টের প্রধান কার্যালয় চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার মোমিনপুর ইউনিয়নের নীলমণিগঞ্জ বাজারে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জুবাইর সিদ্দিকের দাবি, তাঁরা গ্রাহকদের কাছ থেকে এ পর্যন্ত ১৬ কোটি টাকা নিয়েছেন। এর মধ্যে ১৫ কোটি টাকা মূল্যের পণ্য গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। বাকি এক কোটি টাকা মূল্যের পণ্য সরবরাহ অথবা টাকা ফেরত দিতে গ্রাহকদের কাছ থেকে তিন-চার মাস সময় চেয়ে নিয়েছেন।

আদিয়ান মার্ট লিমিটেড যৌথ মূলধন কোম্পানি

ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তরের কার্যালয় থেকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অনুমোদন পায়। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ওই বছরের ফেব্রুয়ারি থেকেই ব্যবসা শুরু করে আদিয়ান। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের চুয়াডাঙ্গা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সজল আহমেদের দেওয়া তথ্যমতে, গত বছরের এপ্রিল থেকেই আদিয়ান মার্টের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসতে শুরু করে। সজল আহমেদ বলেন, ‘শুরু থেকে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত ১১৬ জনের কাছ থেকে লিখিত অভিযোগ পাওয়া গেছে। বেশির ভাগ অভিযোগ টাকা ফেরতের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হয়েছে। তবে আদিয়ান মার্টের সিইও জেলা প্রশাসকের কাছে স্বীকার করেছেন, ভুক্তভোগী গ্রাহকের সংখ্যা চার শতাধিক।’

আদিয়ান মার্ট পরিচালনার দায়িত্বে থাকা চারজনের মধ্যে তিনজনই একই পরিবারের। চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার নীলমণিগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা জুবাইর সিদ্দিক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)। তাঁর স্ত্রী ফারজানা আক্তার চেয়ারম্যান ও ছোট ভাই মাহমুদ সিদ্দিক পরিচালক। তাঁদের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত মিনারুল ইসলাম ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে আছেন।

বিপাকে গ্রাহক ও পণ্য সরবরাহকারী

আদিয়ান মার্টের গ্রাহক ব্যবসায়ী সুব্রত কুমার দত্ত বলেন, ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা দামের মোটরসাইকেল ১ লাখ ৭ হাজার ৯৪০ টাকায় বিক্রির অফার দিয়েছিল আদিয়ান মার্ট। এই ‘আকর্ষণীয়’ অফারের কারণে তিনি ওই প্রতিষ্ঠানে টাকা জমা দেন। সুব্রত বলেন, টাকা কিংবা পণ্য না পেয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ করার পর আদিয়ান মার্ট থেকে তাঁকে ডাকা হয়। টাকা পরিশোধ করার সক্ষমতা থাকলেও তারা অহেতুক সময় চাচ্ছে।

ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা কলেজছাত্র রাকিব হোসেন বলেন, অনলাইনে ৩৭টি পণ্য কিনতে ৮ মাস আগে আদিয়ান মার্টকে ৩ লাখ ২৬ হাজার ১৭৪ টাকা দিয়েছেন। পরবর্তী ৪৫ দিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহের কথা থাকলেও তা করা হয়নি। যোগাযোগ করলেই বলা হয়, দ্রুত টাকা ফেরত দেওয়া হবে। কিন্তু টাকা ফেরত না দিয়ে দিনের পর দিন ধরে হয়রানি করা হচ্ছে।

আদিয়ান মার্টের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন একজন পণ্য সরবরাহকারীও। ঢাকার মোহাম্মদপুরের টোকিও স্কয়ার শপিং কমপ্লেক্সের আনাম টেলিকমের মালিক মোহাম্মদ রনি বলেন, আদিয়ান মার্ট তাঁদের কাছ থেকে মুঠোফোনসহ বিভিন্ন গ্যাজেট কিনে বিক্রি করত। প্রতিষ্ঠানটির কাছে তাঁদের বেশ কিছু টাকা পাওনা আছে। বকেয়া টাকা আজ দেব, কাল দেব করে প্রতিষ্ঠানটির কর্তাব্যক্তিরা তাঁদের হয়রানি করছেন।

‘টাকার অঙ্কে খুবই সামান্য’

অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে জুবাইর সিদ্দিক বলেন, তাঁদের নিবন্ধিত গ্রাহকের সংখ্যা ১ লাখ ৫০ হাজার, যার মধ্যে মাত্র ৪০০ গ্রাহক এক কোটি টাকা মূল্যের পণ্য পাবেন, যা টাকার অঙ্কে খুবই সামান্য। গ্রাহকদের লোভনীয় অফার দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তাঁরা কোনো গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা করেননি। বিদেশি গ্যাজেটগুলো সরাসরি অনেক বেশি কমিশনে কেনা যায় বলে সেগুলো ৮০ শতাংশ ছাড়ে বিক্রি করেন। বিভিন্ন কোম্পানি বিজ্ঞাপনসহ প্রচার-প্রচারণায় যে অর্থ ব্যয় করে, আদিয়ান মার্ট সেই অর্থে গ্রাহকদের সুবিধা দেয়।

জুবাইর সিদ্দিক বলেন, ‘নানামুখী সংকটে যে ডিউ তৈরি হয়েছে, সেগুলো আগামী তিন থেকে চার মাসের মধ্যে ক্লোজ করে দেব। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আরও বড় সুবিধা নিয়ে গ্রাহকদের সামনে হাজির হব।’

‘কঠোর নজরদারিতে’ আদিয়ানের কর্মকাণ্ড

জেলা পুলিশ সুপার মো. জাহিদুল ইসলাম জানান, আদিয়ান মার্টের বিরুদ্ধে তাঁর দপ্তরে এ পর্যন্ত চারটি অভিযোগ এসেছে, যার কোনোটি পণ্য, আবার কোনোটি নগদ টাকা ফেরতের মধ্য দিয়ে সমাধান করা হয়েছে।

আর আদিয়ান মার্টের বিরুদ্ধে গ্রাহকদের অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মো. নজরুল ইসলাম সরকার প্রথম আলোকে বলেন, আদিয়ান মার্টের কর্মকাণ্ড কঠোর নজরদারিতে রাখা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের আর্থিক হিসাব সংগ্রহ ও যাচাইয়ে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) আরাফাত রহমান ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সজল আহমেদকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।