স্মৃতিচিহ্নহীন কবি আহসান হাবীবের জন্মভিটা, মৃত্যুবার্ষিকীতেও নেই আয়োজন
বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি আহসান হাবীব। একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত এই কবির জন্ম পিরোজপুর সদর উপজেলার শংকরপাশা গ্রামে ১৯১৭ সালের ২ জানুয়ারি। অথচ জন্মভিটায় তাঁর কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। আজ রোববার (১০ জুলাই) কবির ৩৭তম মৃত্যুবার্ষিকীতেও তাঁর স্মরণে নেই আয়োজন।
পিরোজপুর-চরখালী সড়কের (পাড়ের হাট সড়ক) বেলতলা স্ট্যান্ডের বাঁ পাশে রয়েছে কবির নামে একটি ফলক। পিরোজপুর জেলা পরিষদ দেড় যুগ আগে নামফলকটি নির্মাণ করেছিল। এর উত্তর দিকে একটি সরু সড়ক ধরে তিন কিলোমিটার পথ গেলে কবির পৈতৃক বাড়ি।
কিছুদূর ইটের ও বাকিটা মাটির সড়ক হয়ে ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কবি আহসান হাবীবের ছোট ভাই প্রয়াত গোলাম কবিরের ঘর ছাড়া কিছু নেই। ওই ঘরে কবির ভাইয়ের পরিবার বসবাস করে।
কবি আহসান হাবীবের ভাইয়ের ছেলে রিয়াদুল কবির বলেন, কবির দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। বড় ছেলে কথাসাহিত্যিক মঈনুল আহসান সাবের ঢাকায় থাকেন। ছোট ছেলে মনজুরুল আহসান জাবের যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী। সন্তানেরা গ্রামে আসেন না। তবে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে।
পিরোজপুর শহরে একটি শোরুমে চাকরি করেন রিয়াদুল কবির। তিনি আরও বলেন, কবির পৈতৃক ভিটা দেখতে দূরদূরান্ত থেকে লোকজন আসেন। কবির ছোট ভাই গোলাম কবির জীবিত থাকতে আগত দর্শনার্থীদের আপ্যায়ন করতেন। কবির শৈশব–কৈশোরের গল্প শোনাতেন। ২০১৮ সালের ১৯ অক্টোবর গোলাম কবির মারা যান। চাকরির কারণে দর্শনার্থীদের সময় দিতে পারেন না রিয়াদুল কবির।
কবি আহসান হাবীবের বাড়িতে কোনো স্মৃতিচিহ্ন না পেয়ে দর্শনার্থীরা হতাশ হয়ে ফিরে যান জানিয়ে রিয়াদুল কবির বলেন, ‘পিরোজপুরের সাবেক জেলা প্রশাসক আজমল হোসেন কবির স্মৃতি রক্ষার্থে উদ্যোগ নিতে চেয়েছিলেন। তিনি বদলি হয়ে যাওয়ায় সেটা হয়নি। আমরা কবির স্মৃতি রক্ষার্থে একটি পাঠাগার ও সংগ্রহশালা করার জন্য জমি দিতে আগ্রহী। এ জন্য সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা দরকার।’
পিরোজপুরের লেখক ও সাংবাদিক জগৎ প্রিয় দাস বলেন, ‘কবি আহসান হাবীব আমাদের পিরোজপুরের কৃতী সন্তান। অথচ এখানে কবির জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী খুব একটা পালন করা হয় না। পৌর শহরে কবির নামে একটি সড়ক ও কবির গ্রাম শংকরপাশায় একটি নামফলক ছাড়া কিছু নেই।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পিরোজপুর জেলা পরিষদের প্রশাসক মহিউদ্দিন মহারাজ বলেন, ‘আমাদের পরিষদ পূর্ণাঙ্গভাবে গঠিত হলে কবি আহসান হাবীবের স্মৃতি রক্ষার্থে একটি প্রকল্প গ্রহণ করব।’
পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, কবি আহসান হাবীবের বাবা হামিজুদ্দীন হাওলাদার কবিরাজ (গ্রাম্য চিকিৎসক) ছিলেন। তাঁর পাঁচ ছেলে ও চার মেয়ের মধ্যে আহসান হাবীব বড়। ১৯৩৪ সালে পিরোজপুর উচ্চবিদ্যালয়ে ছাত্রাবস্থায় স্কুল ম্যাগাজিনে তাঁর প্রথম কবিতা ছাপা হয়৷ ১৯৩৫ সালে প্রবেশিকা পাস করে কবি বিএম কলেজে ভর্তি হলেও, আর্থিক সংকটে পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। ১৯৩৬ সালের শেষ দিকে জীবিকার জন্য বরিশাল থেকে চলে যান কলকাতায়। সেখানে ১৯৩৭ সালে দৈনিক তকবির পত্রিকার সহসম্পাদকের কাজে নিযুক্ত হন।
পরে আহসান হাবীব ১৯৩৭ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত কলকাতার বুলবুল পত্রিকা ও ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত মাসিক সওগাত পত্রিকায় কাজ করেন৷ এ ছাড়া তিনি ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত আকাশ বাণীতে কলকাতা কেন্দ্রের স্টাফ আর্টিস্ট ছিলেন। এরপর দীর্ঘদিন দৈনিক বাংলা পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদনা করেন। ১৯৮৫ সালের ১০ জুলাই কবি আহসান হাবিব ঢাকায় মারা যান।
চল্লিশের দশকের অন্যতম প্রধান এই কবি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৬১ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও ইউনেসকো সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৭৮ সালে একুশে পদক এবং ১৯৯৪ সালে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার পান। কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও ছড়া মিলিয়ে তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ২৫। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হলো ‘রাত্রিশেষ’, ‘ছায়াহরিণ’, ‘সারা দুপুর’, ‘আশায় বসতি’, ‘মেঘ বলে চৈত্র যাবো’ ও ‘বিদীর্ণ দর্পণে মুখ’।