সড়কে ইট দিয়ে পাঁচ ফুট দেয়াল, মানুষের ভোগান্তি

চট্টগ্রামের হাটহাজারী-খাগড়াছড়ি সড়কে যান চলাচল এখনো বন্ধ। সেখানে মাদ্রাসার ছাত্ররা অবস্থান করছেন। সড়কের ওপর করা হয়েছে ইটের দেয়াল। এতে দুর্ভোগে পড়েছে ওই সড়ক দিয়ে যাতায়াত করা নাজিরহাট, খাগড়াছড়ি ও রামগড়ের যাত্রীরা। গতকাল বিকেল ৪টায় চট্টগ্রাম হাটহাজারী মাদ্রাসার সামনে
ছবি: জুয়েল শীল

চট্টগ্রামের অন্যতম ব্যস্ত সড়ক হাটহাজারী-খাগড়াছড়ি সড়ক। এই সড়ক দিয়ে উত্তর হাটহাজারী, নাজিরহাট, ফটিকছড়ি, রামগড়, খাগড়াছড়ি, খেয়াকো ও ফেনীতে আসা–যাওয়া করে যাত্রীরা। কিন্তু এক দিন পার হলেও সড়কটিতে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। বন্ধ রয়েছে চট্টগ্রাম-নাজিরহাট রেল চলাচলও।

এতে দুর্ভোগে পড়েছে যাত্রীরা। দুই পাশে আটকা রয়েছে মালবাহী ট্রাক। বিকল্প সড়ক দিয়ে লোকজনকে গন্তব্যে পৌঁছাতে হচ্ছে। এতে ভাড়া লাগছে দ্বিগুণ, সময়ও লাগছে বেশি। বেশি ভোগান্তিতে পড়তে দেখা গেছে নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের। আজ শনিবার সরেজমিন এ চিত্র দেখা গেছে।

গতকাল শুক্রবার বেলা আড়াইটা থেকে বন্ধ রয়েছে সড়কটি। সড়কের হাটহাজারী বাজার এলাকায় ইটের স্তূপ দিয়ে পাঁচ ফুট দেয়াল দিয়ে রাখা হয়েছে। পাশাপাশি উপজেলা ভূমি অফিসের সামনের সড়ক খুঁড়ে ফেলা হয়েছে। সড়কে আড়াআড়িভাবে রাখা হয়েছে সিমেন্টের ইলেকট্রিক পিলার।

হাটহাজারী সদরের এক কিলোমিটার এলাকায় দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। অতিরিক্ত আড়াই শ র‍্যাব, পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এ ছাড়া বিজিবির ১০০ সদস্য মোতায়েন রয়েছে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতা করে গতকাল জুমার নামাজের পর ঢাকার বায়তুল মোকাররম মসজিদ এলাকায় ধর্মভিত্তিক দলগুলোর নেতা-কর্মী ও মুসল্লিদের একাংশের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী ও পুলিশের সংঘর্ষ হয়। এর প্রতিবাদে দুপুরে বিক্ষোভে নামেন হাটহাজারী মাদ্রাসার ছাত্ররা।

একপর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে ছাত্রসহ চারজন নিহত হন। পরে ছাত্ররা হাটহাজারী-নাজিরহাট সড়ক অবরোধ করেন। চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানায় পুলিশ ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে শুক্রবার মধ্যরাতে হেফাজতের নেতাদের দুই দফা বৈঠকের পর সড়ক ছেড়েছিলেন মাদ্রাসার ছাত্ররা।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ওই বৈঠকের সময় হেফাজতে ইসলামের আমির জুনায়েদ বাবুনগরী শুক্রবার রাত পৌনে ১২টার দিকে মাইকে ঘোষণা দিয়ে ছাত্রদের মাদ্রাসায় ফেরার আহ্বান জানান। এরপর সড়ক থেকে মাদ্রাসায় ফিরে যান তাঁরা। আজ সকালে আবার মাদ্রাসার সামনে জড়ো হন ছাত্ররা। দিনভর তাঁরা সেখানে অবস্থান করেন।

ভোগান্তি

গতকাল বিকেল থেকে সড়ক অবরোধ থাকায় খাগড়াছড়ি, নাজিরহাট, ফটিকছড়ির বাসিন্দাদের শহরে আসতে ভোগান্তি হয়। গাড়ি আটকে যাওয়ায় অনেকে হেঁটে হাটহাজারী বাসস্ট্যান্ড এসে গাড়িতে ওঠে। আবার অনেকে ভেতরের রাস্তা দিয়ে (কামালপাড়া সড়ক) দিয়ে বাসস্ট্যান্ড আসে।

হাটহাজারী-খাগড়াছড়ি সড়কে দুর্ভোগে পড়েছে মানুষ
ছবি: জুয়েল শীল

আজ দুপুরে হাটহাজারী থানার সামনে কথা হয় বেসরকারি কর্মকর্তা ইকবাল হোসেনের সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন স্ত্রী, দুই সন্তান ও বৃদ্ধ মা। তিনি ফটিকছড়ি থেকে নগরে ফিরছিলেন। সকালে সিএনজি অটোরিকশায় করে হাটহাজারী সড়কের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে আসেন। সেখানে থেকে গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকায় হেঁটে সড়কের পশ্চিমে রেললাইন দিয়ে কৃষি গবেষণা সড়ক দিয়ে হাটহাজারী সড়কে ওঠেন। বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত হেঁটে সেখানে থেকে গাড়ি করে নগরে যাবেন। ইকবালের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন তাঁর বৃদ্ধ মা আছিয়া খাতুন ও দুই সন্তানকে খুব ক্লান্ত দেখা গেছে। প্রখর রোদে তাঁদের হাঁসফাঁস করতে দেখা গেছে। একই অবস্থা খাগড়াছড়ি থেকে আসা রবিউল আলমের পরিবারের।

প্রশাসন ও হেফাজত, মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের দফায় দফায় বৈঠক

গুলিতে নিহত চারজনের লাশ হাটহাজারী মাদ্রাসায় এনে জানাজা শেষে গ্রামের বাড়িতে পাঠাতে হবে দাবি ছিল মাদ্রাসাছাত্রদের। কিন্তু প্রশাসনের বক্তব্য ছিল, লাশগুলো চট্টগ্রাম শহরে জানাজা শেষে যাঁর যাঁর গ্রামের বাড়িতে পাঠানো হবে। এ জন্য দুপুর ১২টায়, বেলা ৩টায় ও বিকেল ৫টায় তিন দফা হাটহাজারী থানায় বৈঠক হয়। ৫টার বৈঠকে হেফাজত ও মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ দাবি মেনে নেয়। বৈঠকে স্থানীয় সাংসদ আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন, জেলা পুলিশ সুপার এস এম রশিদুল হক, হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব নাছির উদ্দিন, সহকারী অর্থ সম্পাদক আহসান উল্লাহ, হাটহাজারী মাদ্রাসার শিক্ষক মুফতি জসিম উদ্দিন, মাওলানা ওমরসহ কয়েকজন ছাত্র প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।

লাশের জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের মর্গের সামনে দিনভর অবস্থানের পাশাপাশি গায়েবানা জানাজা আদায় করেন হেফাজতের কর্মীরা। তাঁরা চলে যাওয়ার পর নিহত চারজনের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করে পুলিশ। চট্টগ্রাম নগর পুলিশের পাঁচলাইশ অঞ্চলের সহকারী কমিশনার শহীদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার পর লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এর আগে গায়েবানা জানাজার পর হেফাজতের কর্মীরা চলে যান।

এদিকে চমেক হাসপাতালে চারজন হেফাজতের কর্মী চিকিৎসাধীন বলে জানিয়েছেন হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক জহিরুল ইসলাম।


জিম্মিদশা থেকে মুক্ত এক পুলিশ সদস্য

শুক্রবার পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিতে চারজন নিহতের জেরে হাটহাজারী ডাকবাংলো সামনে থেকে দায়িত্বরত জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার কনস্টেবল মো. সোলায়মানকে ধরে মাদ্রাসায় নিয়ে যান ছাত্ররা। আজ বিকেলে তাঁকে হাটহাজারী থানায় দিয়ে যান হেফাজতের নেতা ও ছাত্ররা।

হাটহাজারী-খাগড়াছড়ি সড়কে মাদ্রাসাছাত্রদের অবস্থান।
ছবি: জুয়েল শীল

জানতে চাইলে কনস্টেবল মো. সোলায়মান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ভালো ছিলাম। তাঁরা কিছু করেননি। তবে চলে আসতে চাইলে তাঁরা দেননি।’

এ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে থানায় আসা ছাত্র আন্দোলনকারী মো. আসাদ বলেন, সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর ছাত্ররা রাস্তায় অবস্থান নেন। নিরাপত্তার জন্য তাঁকে মাদ্রাসা থেকে বের করা হয়নি। এখন একটু শান্ত হওয়ায় তাঁকে বের করা হয়েছে।

সোলায়মান জিম্মি ছিলেন না উল্লেখ করে চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তিনি সেখানে ভালো ছিলেন।


চট্টগ্রাম-নাজিরহাট রেল চলাচল বন্ধ

চট্টগ্রাম-নাজিরহাট রেললাইনে হাটহাজারী রেলস্টেশনে রেললাইনের ওপর বড় বড় কাঠের স্তূপ রাখতে দেখা গেছে আজ। কিছু কিছু জায়গায় আগুনে পোড়া কাঠ রয়েছে। স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, গতকাল রাতে রেললাইনে আগুন দেওয়া হয়।

হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুহুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, বিক্ষুব্ধ মাদ্রাসার ছাত্ররা রেললাইনে কাঠের স্তূপ ফেলে ট্রেন আটকানোর চেষ্টায় ছিলেন। শনিবার ভোরে বিষয়টি জানতে পেরে চট্টগ্রাম শহর ও নাজির থেকে ছেড়ে আসা সব ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। ট্রেন চললে হয়তো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতে পারত।

সরেনি দেয়াল

আজ শনিবার বিকেল চারটার দিকে হেফাজতে ইসলামের আমির জুনায়েদ বাবুনগরী মাইকে ছাত্রদের মাদ্রাসায় ফেরার অনুরোধ করেন। তাঁর অনুরোধের পর সন্ধ্যার আগে বেশির ভাগ ছাত্রই রাস্তা থেকে সরে গেছেন। তবে দেয়াল এখনো সরেনি। কিছু ছাত্র এখনো প্রধান ফটকের পাশে অবস্থান করছেন।

দুপুরে রাস্তায় অবস্থান নেওয়া ছাত্ররা প্রথম আলোকে বলেন, ‘গুলিতে আমাদের চারজন ভাই শহীদ হয়েছেন। আহত আছেন অনেকেই। ভাইদের লাশ আনার ও জানাজা পড়ার এখনো সুযোগ পাইনি। আমরা অবস্থান না নিলে কে নেবে?’

প্রশাসনের বক্তব্য

হাটহাজারী-নাজিরহাট সড়ক বন্ধ থাকায় মানুষের দুর্ভোগ নিয়ে স্থানীয় সাংসদ আনিসুল ইসলাম মাহমুদ প্রথম আলোকে আজ বিকেলে বলেন, ‘আস্তে আস্তে সব হবে। একটু ধৈর্য ধরেন সবাই। হেফাজত ও মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে।’
একই মন্তব্য করেন চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি। ওসি প্রত্যাহার চেয়ে হেফাজতের দাবি প্রসঙ্গে বলেন, তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

সড়ক থেকে ব্যারিকেড তুলে নেওয়া হবে জানান হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব নাছির উদ্দিন মুনির। সন্ধ্যা সাতটায় প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত যান চলাচল স্বাভাবিক হয়নি।

ডাকবাংলোয় আগুন

হাটহাজারীতে ডাকবাংলোর একটি কক্ষে আজ শনিবার রাত আটটার দিকে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন হাটহাজারীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিন। তিনি বলেন, ‘ধারণা করা হচ্ছে মাদ্রাসার ছাত্ররা ডাকবাংলোর একটি কক্ষে আগুন দিয়েছে। এখানে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যাওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, মাদ্রাসার বিপরীতে ডাকবাংলোর অবস্থান। স্থানীয় বাসিন্দারা পানি দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছেন।’

ব্যারিকেড থাকায় ওই এলাকায় যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

এদিকে হেফাজতে ইসলামের স্থানীয় নেতা মীর ইদ্রিস দাবি করেছেন, এতে মাদ্রাসাছাত্রদের সম্পৃক্ততা নেই। তিনি বলেন, ‘মাদ্রাসার ছাত্ররা আগুন দেয়নি। কে বা কারা ডাকবাংলোর বাইরে আগুন দিয়েছে বলে শুনেছি।’

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন
আরও পড়ুন