হঠাৎ ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত, নাটোর আ.লীগে বিরোধের আগুনে ঘি

আওয়ামী লীগ

শুক্রবার রাতে কেন্দ্র থেকে হঠাৎ নাটোর জেলা ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। পদপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে ১০ দিনের মধ্যে চাওয়া হয়েছে আবেদনপত্র। ফলে সম্মেলন না করে কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্তেই গঠিত হচ্ছে নতুন কমিটি। ঘটনাটি নাটোরে আওয়ামী লীগের চলমান রাজনৈতিক উত্তাপে যেন আগুনে ঘি ঢালার পরিস্থিতি তৈরি করেছে।

এর আগে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের কমিটি বিলুপ্তির পর জুলাইয়ে সম্মেলন ছাড়াই নতুন কমিটি গঠন করা হয়। সেই নিয়ে নাটোরের রাজনীতি এখন উত্তপ্ত। সবাই এখন তাকিয়ে, কেন্দ্র থেকে করা জেলা ছাত্রলীগের কমিটিতে জেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের কার কোন অনুসারীরা আসছেন। এ থেকে নেতা-কর্মীরা দলে কোন নেতার জোর কেমন, তা আন্দাজ করতে চাইছেন।

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি শুক্রবার রাতে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় কেন্দ্রীয় কমিটি নাটোর জেলা ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটি বিলুপ্ত করেছে। একই সঙ্গে নতুন কমিটি গঠনের লক্ষ্যে আগামী ১০ দিনের মধ্যে পদপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে আবেদন চাওয়া হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য স্বাক্ষর করেছেন।

আরও পড়ুন
নাটোর জেলা ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি

কমিটি বিলুপ্তির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরপরই জেলা ছাত্রলীগের সদ্য বিদায়ী সভাপতি রাকিবুল হাসান তাঁর ফেসবুক পেজে আবেগঘন একটি পোস্ট দিয়েছেন। তাতে তিনি লিখেছেন, ‘জেলা ছাত্রলীগের নেতৃত্বে এসে সংগঠনের জন্য যতটুকু অর্জন, তার পুরো কৃতিত্বই নাটোর জেলা ছাত্রলীগের তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের। আর সব ব্যর্থতা আমাদের কাঁধে। তবে আমাদের ব্যর্থতার সঙ্গে সম্মানিত জেলা আওয়ামী লীগের নেতা ও সাংসদদের দ্বন্দ্বও জড়িত।’ কমিটি বিলুপ্তির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বাস্তবতার নিরিখে ছাত্রলীগ থেকে বিদায় নেওয়াটা মেনে নিয়েছি।’

গত মে মাসে কেন্দ্র থেকে নাটোর জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের দুই যুগের আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। সম্মেলন ছাড়াই ২০ জুলাই রাতে কেন্দ্র থেকে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের কমিটি ঘোষণা করা হয়। নাটোর-২ (সদর ও নলডাঙ্গা) আসনের সাংসদ শফিকুল ইসলাম ছাড়া জেলার বাকি তিন সাংসদ জুনাইদ আহমেদ, আবদুল কুদ্দুস ও শহিদুল ইসলাম এবং সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাংসদ রত্না আহমেদসহ জেলা আওয়ামী লীগের একটা বড় অংশ স্বেচ্ছাসেবক লীগের নতুন কমিটির নেতাদের অভিনন্দন জানান।

এদিকে স্বেচ্ছাসেবক লীগের বিলুপ্ত কমিটি ২৪ জুলাই জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে নতুন কমিটির প্রতি অনাস্থা জানায়। অবৈধভাবে নতুন কমিটি গঠনে প্রভাব খাটানোর অভিযোগ তোলা হয় সাংসদ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদের বিরুদ্ধে। এমনকি সংবাদ সম্মেলনে নতুন কমিটির সভাপতিকে ‘রাজাকারপুত্র’ ও সম্পাদককে ‘মাদকসম্রাটের সহোদর’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। শুরু হয় উত্তেজনা।

নতুন কমিটি ২৫ জুলাই পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করে। সেখানে দলের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি ও শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে সাংসদ শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানানো হয়। ওই সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয়, সাংসদ শফিকুলের বাবা মরহুম হাসান আলী চিহ্নিত রাজাকার ছিলেন। সাংসদ জেলা আওয়ামী লীগের সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য তাঁর পরিবারের ১১ সদস্যকে দলীয় পদ দিয়েছেন বলেও অভিযোগ করা হয়। এরপর উত্তেজনা আরও বাড়তে থাকে।

ফেসবুক খুললেই নাটোরের রাজনীতির উত্তাপ

স্বেচ্ছাসেবক লীগের ২৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী এবং একই দিন প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদের জন্মদিন উপলক্ষে ২৭ জুলাই স্বেচ্ছাসেবক লীগের নতুন ও পুরাতন কমিটির নেতারা একই স্থানে কর্মসূচি পালন করার ঘোষণা দিলে সংঘর্ষের আশঙ্কা দেখা দেয়। সারা শহরে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করে তাঁদেরকে আলাদা স্থানে কর্মসূচি পালন করানো হয়। পুরোনো কমিটির কর্মসূচিতে সাংসদ শফিকুল ইসলাম এবং নতুন কমিটির কর্মসূচিতে সংরক্ষিত মহিলা সাংসদ রত্না আহমেদ, সদর উপজেলার চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শরিফুল ইসলাম এবং জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মোর্ত্তজা আলী অংশ নেন। উভয় কর্মসূচিতে পরস্পরের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করা হয়।

সাংসদ শহিদুল ইসলাম অভিযোগ করেন, জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া কমিটি মানেন না। এ নিয়ে তিনি বিভেদ সৃষ্টি করে চলেছেন। সংরক্ষিত মহিলা সাংসদ রত্না আহমেদ বলেন, আর একক নেতৃত্ব মেনে নেওয়া হবে না।

কর্মসূচির অংশ হিসেবে ওই দিন বিকেলে নতুন কমিটি ভার্চ্যুয়াল আলোচনা সভার আয়োজন করে। এতে যুক্ত হন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাংসদ আবদুল কুদ্দুস, সাংসদ ও প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ, সাংসদ শহিদুল ইসলাম, সংরক্ষিত মহিলা সাংসদ রত্না আহমেদ, সদর উপজেলার চেয়ারম্যান শরিফুল ইসলাম, নাটোর পৌরসভার মেয়র উমা চৌধুরী প্রমুখ। সভায় আবদুল কুদ্দুস সাংসদ শফিকুল ইসলামকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘আমাকে সভাপতি নির্বাচিত করা হলেও দলীয় অফিসে ঢুকতে দেওয়া হয় না। নাটোর শহরে বাড়ি ভাড়া করে থাকতে দেওয়া হয়নি। দলীয় কর্মসূচিতে ডাকা হয় না। একজনই সব ক্ষমতা হাতে রাখতে চান।’

সাংসদ শহিদুল ইসলাম অভিযোগ করেন, জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া কমিটি মানেন না। এ নিয়ে তিনি বিভেদ সৃষ্টি করে চলেছেন। সংরক্ষিত মহিলা সাংসদ রত্না আহমেদ বলেন, ‘আর একক নেতৃত্ব মেনে নেওয়া হবে না। সাংসদ শফিকুল ইসলামের কথা বলে আমাকে অনুষ্ঠান করতে দেওয়া হয় না। জীবনে কখনো আমার বাড়িতে চোর ঢোকেনি। যেদিন আমি সাংসদ হিসেবে সংসদে গেলাম, সেদিন আমার শয়নকক্ষে চোর ঢুকল। বিছানার ওপর হাঁসুয়া রেখে যায়, এত সাহস চোর কীভাবে পায়?’ নাটোর পৌরসভার মেয়র উমা চৌধুরী বলেন, নাটোরে আওয়ামী লীগের নেতারা এখন আদর্শচ্যুত। এ কারণে আজ শত শত পুলিশের পাহারায় দলীয় অফিসে কর্মসূচি পালন করতে হয়।

নেতাদের এসব বক্তব্য পরদিন ফেসবুকসহ গণমাধ্যমে ঘুরতে থাকে। সাংসদ শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে চার সাংসদ ও জনপ্রতিনিধিদের এককাট্টা হওয়ার খবর এখন মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। ফেসবুক খুললেই নাটোরের রাজনীতির উত্তাপ টের পাওয়া যাচ্ছে।

এমন অবস্থায় শুক্রবার রাতে জেলা ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত হওয়ার খবরে আগুনে ঘি ঢালার উপক্রম হয়েছে। সবার দৃষ্টি, কার কোন অনুসারী নতুন কমিটিতে আসছেন। বিভক্ত নেতাদের কার প্রভাব থাকবে নতুন কমিটিতে। এ নিয়ে শহরজুড়ে চলছে আলোচনা। এ প্রসঙ্গে সদর উপজেলার চেয়ারম্যান শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘কেন্দ্রের প্রতি বরাবরই আমার আস্থা রয়েছে। আশা করছি, তাঁরা যোগ্য নেতৃত্ব উপহার দেবেন।’

সাংসদ শফিকুল ইসলাম পুরো বিষয়টিকে তাঁর বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র বলে মনে করছেন। তিনি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগের কথা বলা হচ্ছে, সেসব সঠিক নয়। অন্য সাংসদেরা তাঁদের বক্তব্যে আমার নাম উল্লেখ করেননি। তাই এ ব্যাপারে আমিও কারও বিরুদ্ধে কিছু বলতে চাই না।’ দলের বা অঙ্গসংগঠনের নেতৃত্ব নির্বাচন গঠনতান্ত্রিক হলে তাঁর কিছু বলার নেই বলে তিনি জানান।