হতদরিদ্রদের ‘সচ্ছল’ দেখিয়ে তালিকা থেকে বাদ

হারুন শেখ দিনমজুর। হতদরিদ্র হিসেবে শনাক্ত করে ২০১৬ সালে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির তালিকায় তাঁর নাম দেওয়া হয়। কিন্তু এবার তাঁকে ‘সচ্ছল’ হিসেবে দেখিয়ে এই তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। হারুনের পরিবর্তে অপর একজনকে তালিকায় ঢোকানো হয়েছে। তিনি ব্যবসা করেন।

হারুনের বাড়ি যশোরের অভয়নগর উপজেলার বাঘুটিয়া ইউনিয়নের ভাটপাড়া গ্রামে। তিনি বলেন, ‘কার্ড বাতিল হওয়ার খবর শুনে মেম্বরের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি বলেছেন, “তিন বছর ধরে চাল পাচ্ছিস, আর কত? সামনে নির্বাচন। আমি নির্বাচন করব। সেই অনুয়ায়ী আমি কার্ড পাল্টায়ে দিয়েছি।”’

শুধু হারুন নন, ওই ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ২২৪ জন হতদরিদ্র ব্যক্তিকে ‘সচ্ছল’ দেখিয়ে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। বাদ পড়া বেশির ভাগ ব্যক্তিই প্রকৃত হতদরিদ্র। তাঁদের পরিবর্তে প্রকৃত সচ্ছল ব্যক্তিদের ওই তালিকায় ঢোকানো হয়েছে। নিয়ম ভঙ্গ করে একই পরিবারের একাধিক ব্যক্তিকেও এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

নীতিমালা অনুসারে, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে ভূমিহীন, কৃষিশ্রমিক, দিনমজুর, উপার্জনে অক্ষম, বিধবা, তালাক পাওয়া, স্বামী ছেড়ে যাওয়া, অসচ্ছল নারীপ্রধান পরিবার এবং যেসব দুস্থ পরিবারে শিশু বা প্রতিবন্ধী রয়েছে—তাদের অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা। একই সঙ্গে কোনো পরিবারের একাধিক ব্যক্তি ও ভিজিডি কর্মসূচির সুবিধা পাওয়া পরিবারকে এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না।

পল্লি অঞ্চলের দরিদ্র লোকজনের স্বল্প মূল্যে খাদ্যসহায়তা ও পুষ্টি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারি বিতরণব্যবস্থায় খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এ লক্ষ্যে ‘খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি নীতিমালা, ২০১৭’ প্রণয়ন করা হয়। এ নীতিমালা অনুসারে, ইউনিয়ন পর্যায়ে বসবাসরত নিম্ন আয়ের দরিদ্র লোকদের মধ্যে হতদরিদ্র পরিবার নির্বাচন করে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এতে ভূমিহীন, কৃষিশ্রমিক, দিনমজুর, উপার্জনে অক্ষম, বিধবা, তালাক পাওয়া, স্বামী ছেড়ে যাওয়া, অসচ্ছল নারীপ্রধান পরিবার এবং যেসব দুস্থ পরিবারে শিশু বা প্রতিবন্ধী রয়েছে—তাদের অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা। একই সঙ্গে কোনো পরিবারের একাধিক ব্যক্তি ও ভিজিডি কর্মসূচির সুবিধা পাওয়া পরিবারকে এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না।

কার্ড বাতিল হওয়ার খবর শুনে মেম্বরের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি বলেছেন, ‘তিন বছর ধরে চাল পাচ্ছিস, আর কত? সামনে নির্বাচন। আমি নির্বাচন করব। সেই অনুয়ায়ী আমি কার্ড পাল্টায়ে দিয়েছি।’
হারুন শেখ, বাঘুটিয়া ইউনিয়নের ভাটপাড়া গ্রামের দিনমজুর

উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের দপ্তর সূত্রে জানা যায়, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে প্রকৃত হতদরিদ্র ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করতে খাদ্য অধিদপ্তর গত ১৮ নভেম্বর একটি চিঠি দেয়। এতে আগের তালিকা থেকে মৃত, সচ্ছল ও ভুয়া ব্যক্তিদের বাদ দিয়ে প্রকৃত হতদরিদ্র ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এর অংশ হিসেবে বাঘুটিয়া ইউনিয়নে ২ হাজার ২২৮ জনের মধ্যে ২৬০ জনকে বাদ দেওয়া হয়। এর মধ্যে ২২৪ জনকে সচ্ছল দেখানো হয়। কিন্তু তাঁদের বেশির ভাগই প্রকৃত হতদরিদ্র বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। এ ছাড়া একই পরিবারের একাধিক ব্যক্তিকেও এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, ভাটপাড়া গ্রামের দিনমজুর আনিসুর রহমানের নাম বাদ দিয়ে তাঁর পরিবর্তে সচ্ছল প্রসাদ কৃষ্ণ দাসকে তালিকাভুক্ত করা হয়। একই গ্রামের হতদরিদ্র রিপন বিশ্বাস, বিকাশ বিশ্বাস, শিমুল বিশ্বাস ও জাহানারা বেগমের নাম বাদ দিয়ে পুঁটিরাম বিশ্বাসের পরিবারের চারজনের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। শিবনগর গ্রামের হতদরিদ্র স্বপন কুমার তিন বছর আগে ভারতে চলে গেছেন। এই তিন বছর তাঁর নামে চাল তোলা হয়েছে। তাঁর পরিবর্তে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সচ্ছল অসিত বিশ্বাসকে। পাইকপাড়া গ্রামের ইউপি সদস্য আব্বাস বিশ্বাসের ভাইয়ের ছেলে বি এম জিয়াউর রহমান, চাচাতো ভাইয়ের স্ত্রী রেভা বেগম ও ভাগনে হাবিব খানকে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাঁরা সচ্ছল। তাঁদের পরিবর্তে হতদরিদ্র রবিউল ইসলাম, মুসারেফ ও মুকুল অধিকারীকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এ গ্রামের হতদরিদ্র সাইদ গাজীকে বাদ দিয়ে সচ্ছল নিতাই মণ্ডল এবং সাইফুল ইসলামকে বাদ দিয়ে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্য জাহিদুর রহমানের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে উপকারভোগীদের নাম সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন করা হয়েছে বাঘুটিয়া ইউনিয়নে। অভিযোগ যখন উঠেছে, তখন আবার তদন্ত করে দেখা যেতে পারে।
মীনা খানম, অভয়নগর উপজেলা খাদ্যবান্ধব কমিটির সদস্যসচিব ও উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক

জানতে চাইলে উপজেলা খাদ্যবান্ধব কমিটির সদস্যসচিব ও উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মীনা খানম বলেন, ‘খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে উপকারভোগীদের নাম সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন করা হয়েছে বাঘুটিয়া ইউনিয়নে। ট্যাগ অফিসারকে দিয়ে আমরা যাচাই-বাছাই করিয়েছিলাম। তাতে কোনো অনিয়ম দেখা যায়নি। অভিযোগ যখন উঠেছে, তখন আবার তদন্ত করে দেখা যেতে পারে।’

উপজেলা খাদ্যবান্ধব কমিটির সভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নাজমুল হুসেইন খান বলেন, বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে।