হত্যাচেষ্টার মামলা করায় চেয়ারম্যানের হুমকিতে এলাকাছাড়া তরুণী

কক্সবাজার জেলার মানচিত্র

কক্সবাজারের সাগরদ্বীপ কুতুবদিয়া উপজেলার আলি আকবর ডেইল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম সিকদারের হুমকি-ধমকিতে এক তরুণী এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। হামলার শিকার হয়ে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা মামলা করায় এ অবস্থা বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী তানজিনা সুলতানা।

তানজিনা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে সম্প্রতি পাস করেছেন। তাঁর বাড়ি কুতুবদিয়া উপজেলার আলি আকবর ডেইল ইউনিয়নের ফতেহআলী সিকদারপাড়ায়। পরিবারে মা ও একমাত্র ছোট ভাই ছাড়া কেউ নেই। বাবার রেখে যাওয়া সামান্য জমিজমার আয়ে চলে সংসার ও তাঁর লেখাপড়া। জাহাঙ্গীর সিকদার ওই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি পদেও আছেন। তবে তিনি হুমকি–ধমকির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ইউপি চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসী উপজেলা সদরের একটি ভবনের দ্বিতীয় তলায় এক আইনজীবীর চেম্বারে ডেকে নিয়ে তানজিনার গলায় ওড়না পেঁচিয়ে হত্যার চেষ্টা করেন বলে অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় তানজিনা সুলতানা বাদী হয়ে গত ১০ জানুয়ারি কুতুবদিয়া থানায় জাহাঙ্গীর সিকদারকে প্রধান আসামি করে ১২ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা আরও ১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা (হত্যার উদ্দেশ্যে মারধর করে জখম, শ্লীলতাহানি ও চুরির অপরাধ) করেন। পুলিশ ইউপি চেয়ারম্যানসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে গত ৯ ফেব্রুয়ারি অভিযোগপত্রও দিয়েছে। এর পর থেকে তানজিনার বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে আওয়ামী লীগের এ নেতা।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. নুরুচ্ছাফা প্রথম আলোকে বলেন, তানজিনার পৈতৃক ভিটেমাটি দখলের জন্য জাহাঙ্গীর সিকদার নানা চক্রান্ত চালাচ্ছেন। এখন মামলা তুলে নিতে তানজিনাকে হত্যার হুমকি দিচ্ছেন চেয়ারম্যান।

তানজিনা সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, থানায় মামলা করার পর থেকে জাহাঙ্গীর সিকদার তাঁকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে চলেছেন। গত ৯ ফেব্রুয়ারি কুতুবদিয়া জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করলে জাহাঙ্গীর আরও বেপরোয়া হয়ে তাঁকে (বাদি) দেখে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন। মামলা তুলে নেওয়া না হলে এলাকায় থাকতে দেবেন না এবং আরও মিথ্যা মামলা দিয়ে তাঁকে (তানজিনা) জেলে পাঠানোর ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন। ইতিমধ্যে তাঁর (তানজিনা) বিরুদ্ধে লোকজন দিয়ে দুটি মামলা করিয়েছেন ইউপি চেয়ারম্যান।

তানজিনা বলেন, জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে ১৭ মার্চ তিনি কুতুবদিয়া থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন। এরপরও হুমকি–ধমকি বন্ধ হচ্ছে না। এখন তিনি এলাকা ত্যাগ করে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

হুমকি–ধমকির কথা অস্বীকার করে ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর সিকদার প্রথম আলোকে বলেন, তানজিনার জায়গাজমি নিয়ে তাঁর কোনো বিরোধ নেই। জমি দখলের ঘটনাও ঘটেনি। বরং তানজিনা তাঁর ওপর হামলা করেছিলেন। আদালতে দাখিল করা পুলিশের অভিযোগপত্রে নাম থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর সিকদার বলেন, পুলিশও চাপে পড়ে তাঁকে মামলার আসামি করেছে। আদালতের বিচারে সত্য–মিথ্যা বেরিয়ে আসবে।

যা আছে অভিযোগপত্রে

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও কুতুবদিয়া থানার উপপরিদর্শক রায়হান উদ্দিন বলেন, গত ৯ ফেব্রুয়ারি তিনি আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। তদন্তে ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর সিকদারের নেতৃত্বে অভিযুক্ত ১২ আসামি ওই তরুণীকে (বাদী) হত্যাচেষ্টা চালিয়েছিলেন, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

অভিযোগপত্রে ১ নম্বর আসামি করা হয়েছে ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর সিকদারকে। ২ নম্বরে একই এলাকার আরিফুল ইসলাম এবং ৩ নম্বর আসামি ফরিদুল আলম। অপর ৯ আসামি হলেন আবদুল্লাহ আল কাইয়ূম কুতুবী, মো. ইলিয়াছ, মো. জাহিদুল ইসলাম, তারেক মইনুল হক, মো. ইদ্রিস. আনছারুল আজিম, তারেক আজিজ, শাহ আলম সিকদার ও শাহাব উদ্দিন। আসামিরা সবাই জামিনে আছেন।

অভিযোগপত্রে উল্লেখ রয়েছে, জাহাঙ্গীর সিকদারের সঙ্গে তানজিনার দাদার পালিত সন্তান মো. শাহজাহান সিকদারের জায়গাজমি নিয়ে বিরোধ ছিল। ইতিমধ্যে বিরোধীয় জায়গাটি জনৈক লিয়াকত আলীর কাছে বিক্রি করে দেন চাচা ফরিদুল আলম। এ ক্ষেত্রে ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর সিকদারের কাছ থেকে ওয়ারিশ সনদ নেওয়া হয়। সনদে একজন ওয়ারিশ কম দেখানো হয়েছে উল্লেখ করে তানজিনা সুলতানা বাদী হয়ে চাচা ফরিদুল আলম, ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর সিকদার ও ইউপি সদস্য এনামুল হকের বিরুদ্ধে কুতুবদিয়া সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন।
এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২০২১ সালের ২৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় কুতুবদিয়া আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ের পাশে আবুল হাশেমের চায়ের দোকানে জাহাঙ্গীর সিকদারের সঙ্গে মামলার সাক্ষী শাহজাহান সিকদারের মধ্যে তর্কাতর্কি ও ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটে।

এরপর আরেকটি ভবনের দ্বিতীয় তলায় অ্যাডভোকেট রাসেল সিকদারের চেম্বারে জাহাঙ্গীর সিকদারের সঙ্গে মামলার বাদির (তানজিনা) বাগ্‌বিতণ্ডা ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর তানজিনার গলায় থাকা ওড়না পেঁচিয়ে তাঁকে হত্যার চেষ্টা করেন। অন্য আসামিরা তানজিনাকে এলোপাতাড়ি কিল–ঘুষি ও লাথি মারতে থাকেন। কয়েকজন তানজিনার কাপড়চোপড় ধরে টানাহেঁচড়া করে শ্লীলতাহানি করেন। এরপর পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে এবং তানজিনাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

তানজিনা সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের ভিটেমাটি কুক্ষিগত করার জন্য ইউপি চেয়ারম্যান এসব চক্রান্ত চালাচ্ছেন।