হবিগঞ্জে টমটম যখন ‘মাথাব্যথা’

হবিগঞ্জ পৌর শহরে টমটমের কারণে প্রতিদিন অসহনীয় যানজট তৈরি হচ্ছে। শহরের প্রধান ডাকঘর এলাকা থেকে ছবিটি তোলা।
ছবি: সুমনকুমার দাশ

হবিগঞ্জ পৌর শহরে যত দূর চোখ যায়, কেবল টমটমের (ব্যাটারিচালিত ‍ইজিবাইক) সারি। সড়কের এপাশ-ওপাশ দুই দিকেই এসব যান একটার পেছনে আরেকটা লেগে আছে। সড়কজুড়েই টমটমের অবস্থান। যাত্রীদের প্রয়োজনের তুলনায় বাহনের সংখ্যা বেশি। পথচারীদের হাঁটারও জো নেই। যেখানে হেঁটে যাওয়া যেত ১০ মিনিটে, সেখানে এসব যানে চড়লে লাগছে আধা ঘণ্টা।

এলাকাবাসীর ভাষায়, শহরের প্রতিটি রাস্তাই দখল করে নিয়েছে টমটম। অবস্থা এমন, যেন এটি টমটমেরই শহর। টমটম এখন এলাকাবাসীর ‘মাথাব্যথার’ বড় কারণ।

স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, টমটমের ভাড়া তুলনামূলকভাবে কম। শহরের যেকোনো প্রান্তে গেলে ভাড়া গুনতে হয় ৫ টাকা। যদিও করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে ভাড়া বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ টাকায়। তবে যাত্রীদের প্রয়োজনের তুলনায় টমটম বেশি সংখ্যায় চলাচল করছে। এতে দিন-রাত সব সময় প্রতিটি রাস্তায় যানজট লেগে থাকে। তাই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে বেশি সময় ব্যয় হচ্ছে। আবার হেঁটে যাতায়াতেরও উপায় নেই। কারণ, সড়কজুড়ে টমটম থাকায় হাঁটার মতো খুব বেশি জায়গা আর সড়কে অবশিষ্ট থাকে না।

টমটম বাড়াচ্ছে যানজট

গত রোববার দুপুরে শহরের প্রধান ডাকঘর এলাকায় সরেজমিনে দেখা গেছে, সড়কের দুই পাশে মাত্রাতিরিক্ত টমটম চলাচলের কারণে যানজট লেগে আছে। যানজটে উভয় পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা শতাধিক যানবাহনের মধ্যে তিনটি ব্যাটারিচালিত রিকশা, দুটি পিকআপ আর একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা ছাড়া বাদবাকি সব কটিই টমটম। এসব যানের চাপে সড়ক দিয়ে পথচারীরা ফাঁকফোকর খুঁজে কায়দা করে হেঁটে চলছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শহরের চৌধুরী বাজার থেকে শায়েস্তানগর পর্যন্ত রয়েছে তিন কিলোমিটার সড়ক এবং বেক রোডে রয়েছে আরও প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার সড়ক। এই দূরত্বের সড়কের মধ্যে সারাক্ষণ কয়েক হাজার টমটম ও ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলের কারণে শহরে যানজট নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আমড়াপুর এলাকার বাসিন্দা রিকশাচালক সাব্বির আহমদ (১৮) জানান, টমটমের চাপের কারণে এই শহরে রিকশাচালকেরাও অসহায়। শহরে এত বেশি টমটম, রিকশা চালাতে অলিগলি খুঁজতে হয়। প্রায় একই মন্তব্য করেন মোহনপুর এলাকার বাসিন্দা কলেজশিক্ষার্থী মো. আবিদুর রহমান। তিনি বলেন, মোটরসাইকেল চালাতে এই শহরে সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয়। টমটমের কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অসহনীয় যানজটের কবলে পড়তে হয়।

যাত্রীর প্রয়োজনের তুলনায় হবিগঞ্জ পৌর শহরে টমটমের সংখ্যা বেশি। শহরের চৌধুরীবাজার এলাকা থেকে ছবিটি তোলা।
ছবি: সুমনকুমার দাশ

প্রয়োজনের চেয়ে টমটম বেশি

প্রয়োজনের চেয়ে বেশি টমটম চলাচল করায় শহরে যানজট তীব্র রূপ নিয়েছে বলে একাধিক বাসিন্দা অভিযোগ করেছেন। ভুক্তভোগীরা জানান, যানজটের পাশাপাশি টমটমের কারণে প্রায়ই দুর্ঘটনাও ঘটছে। এসব যানের কারণে যাত্রীর সুবিধা নিশ্চিত হওয়ার চেয়েও ভোগান্তি বহুগুণে বেড়েছে। ব্যাটারিচালিত হওয়ায় উচ্চ আদালতের নির্দেশে সারা দেশে টমটমের চলাচল নিষিদ্ধ হলেও হবিগঞ্জ পৌরসভা এসব টমটম চলাচলে নিয়মিত নম্বর প্লেট ইস্যু করে অনুমতি দিচ্ছে। ফি বাবদ কিছু টাকা পাওয়ার আশায় পৌর কর্তৃপক্ষ এসব যান চলাচলে অনুমতি দিয়ে যানজটের পাশাপাশি নাগরিক দুর্ভোগ বাড়াচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় লোকজন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একেকটি টমটম নিবন্ধনের জন্য পৌর কর্তৃপক্ষকে আট হাজার টাকা দিয়ে নম্বর প্লেট নিতে হয়। এ প্লেট না নিলে ওই টমটম অনুমোদনহীন ও অবৈধ বলে গণ্য করা হয়ে থাকে।

স্থানীয় বাসিন্দা ও পৌরসভার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকে জানা গেছে, ২০১০ সালের দিকে শহরে টমটম চলাচল শুরু হয়। শুরুতে এসব যান সংখ্যায় কম থাকায় যানজটের তীব্রতা ছিল না। তখন টমটম যাত্রীদের কাছে জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে টমটমের সংখ্যা। এখন ১ হাজার ৩০০ অনুমোদনপ্রাপ্ত টমটম শহরে যাত্রী পরিবহন করছে। এর বাইরে আরও প্রায় দেড় হাজার টমটম অনুমোদন ছাড়া চলছে। এর বাইরে রয়েছে প্রায় দুই হাজার অনুমোদনহীন ব্যাটারিচালিত রিকশা। সেই সঙ্গে আরও কয়েক হাজার সিএনজিচালিত অটোরিকশা, প্যাডেল রিকশা, পিকআপ, ট্রাক ও ব্যক্তিগত গাড়ি রয়েছে। এসব যানের কারণে ছোট্ট শহরে যানজট এখন নিত্যসঙ্গী।

শহরের নতুন ও পুরোনো বাসস্ট্যান্ড, চৌধুরীবাজার, বাইপাস রোড, পুরোনো খোয়াই ব্রিজ, কালীবাড়ি, তিনকোনা পুকুরপাড়, সবুজবাগ, এম এ মোত্তালিব চত্বর, টাউন হল, পুরোনো হাসপাতাল সড়ক, বাণিজ্যিক এলাকায় দেখা গেছে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজট লেগে থাকে। এর মধ্যে আবার শহরের বিপণিবিতান ও দোকানে কোনো পার্কিং ব্যবস্থা নেই। দুজন সচেতন বাসিন্দা জানান, শহরের জন্য এক হাজারের বেশি টমটমের প্রয়োজন নেই। সেখানে কয়েক হাজার টমটম চলাচল করছে। এতে শিক্ষার্থী ও জরুরি প্রয়োজনসহ চিকিৎসাস্থলে রোগীদের পৌঁছাতে বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে।

টমটম চলাচলে সারা দেশে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও পৌর কর্তৃপক্ষ এসব যান চলার পক্ষে কীভাবে নম্বর প্লেট ইস্যু করছে, জানতে চাইলে মেয়র মো. মিজানুর রহমান জানান, শহরবাসীর চলাচলের পথ সুগম করতে জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় অনুমোদনের পরিপ্রেক্ষিতে শহরে চলাচলের জন্য টমটমকে নিবন্ধনের আওতায় নিয়ে আসা হয়। তিনি নির্বাচিত হওয়ার আগে থেকেই এসব যান চলাচল করছে। তাঁর দায়িত্ব গ্রহণের আগে ১ হাজার ২০০ টমটম চলাচলের জন্য পৌরসভার অনুমোদন ছিল। চাহিদা থাকায় তিনি নতুন করে আরও ১০০ টমটম চলাচলে অনুমোদন দিয়েছেন।

মেয়র আরও বলেন, ‘যে পরিমাণ টমটম পৌর কর্তৃপক্ষ চলাচলের অনুমোদন দিয়েছে, তা সঠিক। কিন্তু শহরে অনুমোদনহীন টমটম ও ব্যাটারিচালিত রিকশা বেড়ে যাওয়ায় যানজট বেড়ে গেছে। এর মধ্যে বিপণিবিতান ও বড় বড় দোকানের নিজস্ব পার্কিং ব্যবস্থাও নেই। তাই যানজট প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তবে শহরকে যানজট মুক্ত রাখতে প্রায়ই অবৈধ টমটম ও ব্যাটারিচালিত রিকশার বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়। এটি অব্যাহত থাকবে।’