হাওর ভরে গেছে পানিতে, দাসপাড়ায় বেড়েছে ব্যস্ততা

উপজেলার দাসপাড়া গ্রামের প্রায় ৫০০ বাসিন্দা চাঁই তৈরির সঙ্গে জড়িত। এ আয় দিয়ে তাঁদের সংসার চলে।

ঘরের এক পাশে মাছ ধরার চাঁই সাজিয়ে রাখা হয়েছে। আরেক পাশে চাঁই তৈরিতে ব্যস্ত এক কারিগর। সম্প্রতি কিশোরগঞ্জের ইটনার দাসপাড়ায়
ছবি: প্রথম আলো

কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার দাসপাড়ায় মাছ ধরার চাঁই তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কারিগরেরা। তবে চায়না দোয়ারি জাল আসায় এখন আর দিন ভালো যাচ্ছে না তাঁদের।

স্থানীয় ব্যক্তিরা বলেন, গ্রামটির নাম দাসপাড়া হলেও এটি হাওরাঞ্চলে চাঁই গ্রাম হিসেবে পরিচিত। এখানকার শতাধিক পরিবারের প্রায় ৫০০ ব্যক্তি চাঁই তৈরির কাজের সঙ্গে জড়িত। চাঁই তৈরির আয় দিয়ে পরিবারসহ ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার খরচ চালান তাঁরা।

সম্প্রতি দাসপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিটি পরিবারের নারী-পুরুষসহ ছোট থেকে বড় সবাই চাঁই তৈরির কাজে ব্যস্ত। কেউ বাঁশ থেকে কাঠি তৈরি করছেন। কেউ কাঠি ও প্লাস্টিকের চিকন রশি দিয়ে চাঁই তৈরিতে ব্যস্ত। অনেকেই প্লাস্টিকের বস্তা কেটে তৈরি চাঁই মুড়াচ্ছেন। কেউ আবার নৌকায় চাঁই ভরছেন।

গ্রামের লনি দাস বলেন, তিনি বাবার কাছ থেকে ছোটবেলায় চাঁই বানানো শিখেছেন। এখন তাঁর একমাত্র পেশা এটি। একসময় তাঁদের অবস্থা ভালো গেলেও এখন চায়না দোয়ারি জালের কারণে তাঁদের চাঁই আর আগের মতো বিক্রি হয় না। কারণ, চায়না দোয়ারি জাল মাছের সব পোনাসহ শিকার করে ফেলে।

গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, সারা বছর চাঁই তৈরির কাজ করলেও বৈশাখ থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত তাঁদের দম ফেলার ফুরসত থাকে না। এ সময় হাওরে পানি আসায় মানুষের হাতে অন্য কাজ তেমন থাকে না। তখন তাঁরা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চল ছাড়াও সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও নেত্রকোনার অনেক জেলে এখান থেকে চাঁই কিনে নিয়ে যান।

নৌকা নিয়ে ময়মনসিংহের নান্দাইল থেকে চাঁই কিনতে এসেছিলেন কলিমউদ্দিন ও আফসার উদ্দিন। তাঁরা ৮০টি চাঁই কেনেন। চলে যাওয়ার সময় বলেন, কয়েক জেলার হাওরাঞ্চলজুড়ে ইটনার দাসপাড়ার চাঁইয়ের সুনাম আছে।

চাঁই তৈরির কারিগরেরা বলেন, হাওরাঞ্চলে বিভিন্ন প্রজাতির দেশীয় মাছের পাশাপাশি প্রচুর চিংড়িসহ ছোট মাছ পাওয়া যায়। এসব চিংড়ি ও ছোট মাছ ধরার জন্য বিশেষ কায়দা করে বাঁশের কাঠি, প্লাস্টিকের রশি ও বস্তা দিয়ে মুড়িয়ে প্রায় চার ফুট লম্বা এবং সোয়া ফুট চওড়া পাইপের মতো ফাঁদ তৈরি করা হয়। এর এক পাশ দিয়ে ছোট মাছ ঢুকতে পারে, কিন্তু বের হতে পারে না। এগুলোকে চাঁই বলে।

গ্রামের বাসিন্দা পূজা রানী ও হরিদাস বলেন, দাসপাড়ার লোকজন প্রায় সারা বছর চাঁই তৈরির কাজ করেন। বাঁশ ও অন্যান্য জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন প্রতিটি চাঁই তৈরি করতে তাঁদের ৪০ থেকে ৫০ টাকার মতো খরচ হয়। বর্ষার সময় তা ১০০ থেকে ১৪০ টাকায় বিক্রি করতে পারলেও অন্য সময় কিছুটা কমে বিক্রি করতে হয়। একেকজন গড়ে প্রতিদিন চার-পাঁচটা চাঁই তৈরি করতে পারেন। এভাবে একেকটি পরিবার বছরে প্রায় তিন থেকে পাঁচ হাজার চাঁই তৈরি করে দুই থেকে তিন লাখ টাকার চাঁই বিক্রি করতে পারেন।

হরিদাস বলেন, পুঁজির স্বল্পতার জন্য বাপ-দাদার এ পেশা টিকিয়ে রাখা এখন তাঁদের জন্য কঠিন হয়ে যাচ্ছে। সরকার যদি সহজে ঋণ দিয়ে আর্থিক সহায়তা করে, তাহলে এ কুটিরশিল্প বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাফিসা আক্তার বলেন, দাসপাড়াসহ যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে চাঁই তৈরির সঙ্গে জড়িত, তাঁদের এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারি সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।