হাওরাঞ্চলে ফিরেছে আমনের হাসি

হাওরাঞ্চলে রোপণ করা আমন। আগে এই জমিতে শুধু বোরো ফসল হতো। বৃহস্পতিবার মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার কাউয়াদীঘি হাওরাঞ্চলের চকেরবন্দে
প্রথম আলো

অন্য বছর এই সময়ে যে জমির ওপর থইথই করেছে পানি, যেদিকে চোখ গেছে পানি ছাড়া আর কিছু দেখা যায়নি, সেই জায়গাগুলোতে এবার কৃষকেরা আমনের চাষ করেছেন। আমনের সবুজ চারায় ঢেউ খেলছে খেতে। কৃষকের মুগ্ধ চোখ সেই ধান সোনালি হওয়ার অপেক্ষায় প্রহর গুনতে শুরু করেছে।

মৌলভীবাজারের কাউয়াদিঘি হাওরসহ সব কটি হাওর এলাকাতেই এবার অন্যবারের চেয়ে আমন ধানের চাষ বেড়েছে। যে অঞ্চলের কৃষকদের একমাত্র ফসলই হচ্ছে বোরো ধান, সেই কৃষকেরা বাড়তি ফসল হিসেবে আমন ধান ঘরে তোলার স্বপ্ন দেখছেন।

কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, এবার সারা জেলায় আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ১ হাজার ২৩৫ হেক্টরে। এর মধ্যে হাওরাঞ্চলে হচ্ছে প্রায় দেড় হাজার হেক্টরে। কাউয়াদিঘি হাওরেই এক হাজার হেক্টরের বেশি জমিনে আমন চাষ হয়েছে। অন্যগুলোর মধ্যে হাকালুকি ও হাইল হাওর রয়েছে। দু-তিন বছর আগেও জেলার হাওরাঞ্চলে আমন চাষ ছিল প্রায় শূন্য।

এদিকে জেলায় আমন ধানের ৮০ শতাংশ রোপণ হয়ে গেছে। বাকিটুকুও কিছুদিনের মধ্যে লাগানো শেষ হবে। হাওরাঞ্চলে ব্রি-ধান ৫১, ব্রি-ধান ৫২, ব্রি-ধান ৪১, বিআর-২২ ও ২৩ জাতের ধানের চাষ বেশি হয়েছে। গত বছর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ১ হাজার ৫৮ হেক্টর। এবার লক্ষ্যমাত্রাও বেড়েছে।

কৃষি বিভাগ, কৃষক ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এবার অন্য বছরের তুলনায় হাওরে পানি কম হয়েছে। টানা বৃষ্টির দেখা মেলেনি। অন্য বছর এই সময়ে যে জমিতে পানি থাকত, সেখানে এখন পানি কম। তা ছাড়া কাউয়াদিঘি হাওরে কাশিমপুর পাম্প হাউসের মাধ্যমে সেচ দেওয়ার পরও পানি বাড়তে পারেনি। পানি কম থাকার সুযোগটা কাজে লাগিয়েছেন কৃষকেরা। তাঁরা আমন চাষে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এরই মধ্যে হাওরাঞ্চলের বেশির ভাগ খেতেই আমন ধান রোপণ শেষ হয়ে গেছে। অতীতে এসব জমিতে শুধু বোরো ধানেরই চাষ হয়েছে। বোরো ফসলের ওপরই নির্ভর করে থাকতেন কৃষকেরা।

এবার সারা জেলায় আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ১ হাজার ২৩৫ হেক্টরে। এর মধ্যে হাওরাঞ্চলে হচ্ছে প্রায় দেড় হাজার হেক্টরে। কাউয়াদিঘি হাওরেই এক হাজার হেক্টরের বেশি জমিনে আমন চাষ হয়েছে।

কাউয়াদিঘি হাওরের মৌলভীবাজার সদর উপজেলার আখাইলকুরা, একাটুনা ইউনিয়নের হাওরাঞ্চল এবং রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁও, উত্তরভাগ ইউনিয়নের হাওরাঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, পানি কম থাকায় কৃষকেরা এরই মধ্যে বেশির ভাগ জমিতে আমনের চারা রোপণ করে ফেলেছেন। তবে গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে হাওরে পানি কিছুটা বেড়েছে। এতে হাওরের নিচের দিকে পানি কম দেখে যাঁরা বীজতলা তৈরি করেছিলেন, সেসব স্থানের কিছু বীজতলা পানিতে তলিয়ে গেছে। সেখানে পানি না কমা পর্যন্ত অবশ্য কৃষকদের অপেক্ষা করতে হচ্ছে।

কাউয়াদিঘি হাওরপারের অন্তেহরি গ্রামের গণপতি দাশ বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে আমাদের এলাকায় বোনা আমন (কাতারি) চাষ হতো। মনু নদ প্রকল্প হওয়ার পর আমন খেত উঠে গেছে। তিন-চার বছর ধরে সেচ দেওয়ায় শুধু আমাদের এলাকাই না, হাওরপারের সব এলাকাতে আবার আমন চাষ শুরু হয়েছে। মানুষ উপকৃত হয়েছেন।’ তিনি জানান, কিছু জমিতে রোপণ হয়ে গেছে। পানি বাড়ায় কিছু বীজতলা তলিয়েছে। সেচ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু জলমহাল ইজারাদারের কারণে সেচ বন্ধ করা হলে চাষাবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

কৃষি বিভাগ ও পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, মৌলভীবাজার সদর ও রাজনগর উপজেলা নিয়ে কাউয়াদিঘি হাওর। হাওরের বেশির ভাগ পড়েছে রাজনগরে। শুকনা মৌসুমে বোরোতে সেচ প্রদান এবং বর্ষায় হাওরের জলাবদ্ধতা নিরসনে ১৯৮৩ সালে মনু নদ প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত কাশিমপুরে পাম্প হাউস স্থাপিত হয়। তবে দীর্ঘদিন ব্যবহৃত হওয়ায় পাম্পটি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছিল না। এতে ১৫-২০ বছর ধরে হাওরাঞ্চলে বর্ষায় দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা হয়েছে। হাওরাঞ্চলে আমন চাষ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। বোরো ফসলও নিয়মিত ঘরে তুলতে পারছিলেন না কৃষক। এমতাবস্থায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে পাম্প হাউস প্রকল্পের মাধ্যমে পাম্পের কার্যক্ষমতা ও নিষ্কাশন সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। এতে গত ২০১৯ সালে হাওরাঞ্চলে আমনের কিছুটা চাষ হয়েছে। গত বছর (২০২০) সেই চাষের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এবার আমন চাষের আওতা আরও বেড়েছে।

মৌলভীবাজার সদর উপজেলার শেওয়াইজুড়ীর কৃষক সমসু মিয়া বলেন, এখন দিন বদলে গেছে। আগে এই সময়ে কাউয়াদিঘিতে পানি আর পানি থাকত। এ বছর পানি কম থাকায় সাহস করে আমন চাষ করেছেন।

রাজনগর উপজেলার কাউয়াদিঘি হাওরপারের পাঁচগাঁও ইউনিয়নের পশ্চিম ভাগের কৃষক ছয়ফুল ইসলাম ও নেপুর আলী বলেন, দুই-তিন বছর ধরে তাঁরা ভালোভাবেই আমন ফসল চাষ করতে পারছেন। আগে জমি থেকে পানি যখন নামত, তত দিনে আমন চাষের মৌসুম চলে যেত। নিয়মিত সেচ দেওয়ার কারণে আমন চাষ করা সম্ভব হচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মৌলভীবাজারের উপপরিচালক কাজী লুৎফুল বারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এবার টানা বৃষ্টি হয়নি। যে কারণে হাওরে পানি কম হয়েছে। কাউয়াদিঘি হাওরে সেচও চালু আছে। এতে হাওরাঞ্চলে আমনের আবাদ বেড়েছে। আবহাওয়ার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কৃষকেরা মানিয়ে নিচ্ছেন। আগে এসব জমিতে শুধু বোরোই হতো। ধানের মূল্য বাড়ায় কৃষকেরাও চাষে আগ্রহী হয়েছেন। হাওরের মধ্যে বেশি বেড়েছে কাউয়াদিঘিতে। হাকালুকি ও হাইল হাওরেও কিছু আমন হয়েছে। উপপরিচালক বলেন, সামনে পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টিপাত হতে পারে। কিছু ধান তলিয়ে নষ্ট হলেও বিলম্বে আবার রোপণ করা যাবে। বীজতলা তৈরি আছে।